আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

''নিধির চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ''

''নিধির চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ''
by-শাহজাহান সিরাজ

দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। খোলার নাম ধাম নেই। রাহাতদের দরজাটায় কি কারনে যেন আজকাল ভেতর থেকে তালা লাগানো থাকে। আর কোনো এক আশ্চর্য কারনে আমি এসে নক করলেই বাড়ির মানুষগুলো চাবি খুঁজে পায় না। এখানে রেখেছিলাম,ওখানে রেখেছিলাম,একটু দাড়ান, এইতো খুলছি- জাতীয় কথাবার্তার পর কেউ একজন এসে বিব্রত মুখে দরজা খোলে। প্রতিদিনই।

আমার এই চাঁর-পাচ মিনিট কা

টে মুঠোফোনে বিনাকারনে গুতোগুতি করে। আজও সেই কাজ করছিলাম। হঠাত সেই অস্বস্তিবোধ ফিরে এলো। সেই অস্বস্তিবোধ বলার কারন হলো এই অনুভূতিটা আজ কদিন ধরেই হচ্ছে। কারন অজানা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে একটা ব্যাপার থাকে। এটাকে প্রতিদিনই কাজে লাগাচ্ছি কিন্তু ভোতা ইন্দ্রিয় কিছুতেই কূল কিনারা করতে পারছে না।

দুদিন ধরেই এদিকটায় বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। হল থেকে বেরোবার সময়ই আকাশের গোমরা মুখ দেখে এসেছিলাম। বৃষ্টি আসার কত দেরি দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো দোতলার বারান্দায়। গ্রীলের ভেতর থেকে এদিকেই তাকিয়ে আছে হরিনের মতো সজল দুটো চোখ। থমকে গেলাম । স্তব্ধ-আড়ষ্ট-অভিভূত হয়ে গেলাম। ও চোখেই দেখে নিলাম আমার সর্বনাশ।

- স্যার। আসুন। দরজা খুলে গেছে খেয়ালই করি নি। রাহাতের কন্ঠ কানে যেতেই যেন পৃথিবীতে ফিরে এলাম।
- ও হ্যা। চল। বলে আবার উপরে তাকালাম। নেই। হরিনী নিরুদ্দেশ।

**

হরিনীর পরিচয় আমার পেতেই হবে। কিন্তু কিভাবে ? স্টুডেন্টকে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসবো? যদি কিছু ভেবে বসে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাত মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।

- নতুন কিছু পড়াবো না আজ। তোমার ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং দেখবো। রাইট আ প্যারাগ্রাফ এবাউট ইউর ন্যেইবার ! ইন ডিটেইলস !!
- ওকে স্যার। কিন্তু আপনি এসিস্ট করবেন।
- তা করা যাবে। কিন্তু তুমি অবশ্যই প্রত্যেকের ব্যাপারে ডিটেইলস লিখবা। তোমাদের উপর তলার ন্যেইবারদের নিয়েই নাহয় লিখো।

স্টুডেন্ট এর প্যারাগ্রাফে হরিনীর ব্যাপারে দুটি তথ্য পেলাম। নাম নিধি। দুদিন বাদেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।

এরপর নিধির সাথে প্রতিদিনই দেখা হতো। আমি রাহাতদের দরজায় নক করে উপরে তাকালেই নিধিকে দেখতে পেতাম। রাহাতকে পড়ানো শেষ করে বেড়িয়ে যাবার সময় এটা পড়ে রাখবা, ওটা পড়ে রাখবা, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় আসবো ইত্যাদি কথা বলতাম জোড়ে জোড়ে। আপ্রান চেষ্টা থাকতো আমার গলার স্বর যেন ওপরতলায় পৌছায়। নিধি যেন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়!

আমার এরুপ দায়িত্বশীলতা থেকেই কিনা কে জানে জীবনে প্রথমবার ভাগ্যটাকে নিয়ে আহ্লাদ করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। রাহাতে আম্মু একদিন ড্রয়িং রুমে এসে বললো

- আমাদের বাড়িওলার এক মেয়ে আছে। সামনে ওর এইচেসসি ফাইনাল। আপনি কি ওকে কদিন অংক দেখাতে পারবেন? বাড়িওলার ইচ্ছা এমনই।

- জী আন্টি অবশ্যই। বলেই বুঝলাম যত দ্রুত উত্তর দিলাম তত দ্রুত বোধহয় মাধ্যাকর্ষন ভাঙ্গার জন্য রকেটকেও আজকাল ছুটতে হয় না । আন্টির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম উনি আমার শর চেষ্টায় আটকে রাখা খুশিটা ধরে ফেলেছেন কিনা।
**
নিধিকে পড়াতেগিয়ে দুটো বিষয় আবিস্কার করলাম। এক, মেয়েটি বোবা। দুই, তাকে ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব না। ওর পাখির নীড়ের মতো গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলতে ইচ্ছে করতো- তোমাকে চাই। কিছু না বুঝলে ও যখন দু-ঠোট ফুলিয়ে মাথা এদিক-ওদিক নাড়তো তখনো বলতে ইচ্ছে করতো -'তোমাকে চাই!' কিছু বোঝানোর সময় গভীর মনোযোগে যখন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতো তখনও বলতে ইচ্ছে করতো- 'তোমাকেই চাই।' নিধিও কি আমাকে চাইতো না?

নিধির বাবা মা অবশ্য আমাকে ভীষন চাইতো। প্রতিদিন এক ঘন্টার যায়গায় দু ঘন্টা পড়ালে এটা হওয়াটাইতো স্বাভাবিক। আমি প্রতিদিন চেষ্টা করতাম নিধিকে মনের কথাটা বলে ফেলতে। পকেটে চিঠিটা ছিলো একেবারে প্রথম দিন থেকেই। বের করাটাই হয়ে ওঠেনি।

**
আজ নিধিদের বাসায় আমার শেষ দিন। দুদিন বাদে ওর পরীক্ষা তাই আমার আর আসার প্রয়োজন হবে না। আজ যদি বলতে না পারি আর হয়তো কখনোই বলা হবে না। তিরিশ মিনিট ধরে বলার চেষ্টা করছি। মুখ খুলছি। হাত নাড়ছি।থেকে যাচ্ছি। এতটা অপ্রস্তুত কখনোই লাগে নি নিজেকে। নিধিও অপ্রস্তুত আমার এমন আচরনে। বলেই বসলাম শেষমেষ। স্নায়বিক উত্তেজনায় একটু বোধ হয় জোড়েই বলে বসলাম। নাহলে এই ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা থেকে নিধির মা সাথে সাথে উঠে আসবেন কেন? কপাল! আমি কি আর জানতাম ওখানে বসে গত একমাস ধরে তিনি আমাদের পাহারা দেন !!

ফলাফল হলো ভয়াবহ। আমাকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে ভদ্রভাষায় বের করে দেয়া হলো। তারচেয়েও ভদ্রভাষায় রাতে ফোন করে রাহাতের মা জানালেন আমার আর আপাতত ওদিকটায় যাওয়ার দরকার নেই। শেষ সম্বল টিউশনি দুটো হারিয়ে আমি তখন দুচোখে অন্ধকার দেখছি। এরপরেও যে নিধিকে একবার দেখার আশায় নিধিদের বাসার সামনের রাস্তাটায় যাইনি এমন তো নয়। কিন্তু বারান্দায় আর তাকে দেখা পাই নি। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। নিজেকে স্বান্তনা দিলাম এই ভেবে যে- আমার এই অনিশ্চয়তা মাখা জীবনে নিধিকে আর নাই-বা জড়ালাম।
**
তিনবছর পর আজ হঠাত সেদিনের কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো সেই দিনটির কথাও যেদিন নিধি রাহাতের কাছে ঠিকানা নিয়ে আমার হল পর্যন্ত চলে এসেছিলো। সেদিন কি কাপুরুষের মতো ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসাটা ঠিক ছিলো না?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির রাস্তাটায় মোড় নিয়েছি। হর্ন বাজাতেই গেট খুলে গেলো। গাড়িটা কোনোরকম গ্যারেজে রেখেই দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। গ্যারেজ থেকে দরজার রাস্তাটাও আমি পার হই রকেট গতিতে। শুধু তার কারনে । দোতালার বারান্দা থেকে যে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকে গভীর মায়াভরা চোখে। যার চোখে একদিন দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।