আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৩

ছিলে মোর প্রথম সখা ...

ছিলে মোর প্রথম সখা ...
লিখেছেনঃ Pradyut Baran Chowdhury

বুকের উপর বিশাল জলাভূমি, ভয়ে কাঁপছি নানাভাই যদি ওখান থেকে পড়ে যায় ! আম্মুকে চিতকার করে ডাকছি । আম্মু শুনতে পাচ্ছেনা, বাইরে তুমুল বৃষ্টি । তাই আমিও যেতে পারছিনা নানাভাইকে হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য, নানাভাইয়ের লাঠিটা হঠাৎ নড়ে উঠল । আরেক পশলা ভয়, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম । নানাভাই… নানা… নানা ভাই……

আম্মু আমাকে স্বাভাবিক করার অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন আর আমি নানা ভাইয়ের জন্য কেঁদেই যাচ্ছি। নানা মারা যাবার পরে প্রায়ই আমি এই দুঃস্বপ্ন টা দেখি । আমি তখন সাড়ে তিন বছরের, আমার ভাই তখন আম্মুর পেটে। আম্মুর পুনরায় জন্মধারন আমার মানসিক পীড়া্র কারণ ছিল । আমি তখনও বুকের দুধ না খেয়ে ঘুমাতাম না । আমাকে নিয়ে তাই নানী্র বাড়ীমুখী হলেন আম্মু । আমাদের বাড়ী থেকে সেখানে যেতে দুমিনিট সময় লাগে । এরপরে মেজমামা ছোট মামা নিয়ে ব্যস্তই থাকতাম একরকম । কিন্তু গোল বাধল, যখন দুই মামা মিলে বাইরে পড়তে চলে গেলেন ।

আম্মু প্রতিদিনের মত সকাল-বেলাতেই আমাকে নানার বাড়ীতে প্রেরন করলেন । বাড়ীতে শুধু অসুস্থ নানাভাই আর নানী । আমার স্থান হল নানার রোগশয্যার পাশে । আমার ছোট্ট মনে তখন এক পৃথিবী প্রশ্ন , এই মানুষটা সারাক্ষণ শুয়ে থাকেন কেন ? হাঁটেন না কেন ? বাইরে বের হন না কেন ? সবার সঙ্গে বসে খান না কেন ? কারু বাসায় বেড়াতে যান না কেন ? কটর কটর করে সব নানাকেই জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম । সেই থেকে নানা ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্যতার শুরু, আজো নানা আমার কাছে তেমনি প্রিয় একটি মানুষ । নানা একটু একটু করে সুস্থ হতে লাগলেন ।

আমাদের খেলাঘর তখন নানার রোগশয্যা শেষ খড়েড় গাদার উপরে । সারাদিন কি যে গল্প, সেই গল্পের ও কোনো শেষ ছিলনা । রাজা-রানী সুখে ঘর করতে লাগলেন, এরপরে কি নানাভাই ?? নানাভাই হেসে বলতেন এরপরে একদিন তোকে আমার সঙ্গে ওদের ওখানে যেতে বললেন । আমি তখন অভিমানে বলতাম তুমি আমাকে নিয়ে যাওনি কেন ? দিঘী্র জল তখন পাড় পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার চিন্তায়, বর্ষাকাল এসে সেটাকে আরেকধাপ উতসাহিত করেছিল । আমি জানালার ধারে বিছানায় বসে সেদিকে তাকিয়ে ছিলাম, মনটা খুব খারাপ আমার । বৃষ্টির দাপটে পরাজিত হয়ে আজ আম্মু আমাকে নানাবাড়ীতে পাঠাতে ব্যার্থ হয়েছেন ।

হঠাৎ নানাভাইয়ের কন্ঠে আমার নাম শুনে চমকে যাই !! রাস্তায় তাকিয়ে দেখি দূর্বল পায়ে লাঠি হাতে নানা এঁটেল মাটির অমসৃ্ন পথ মাড়িয়ে আমাদের বাড়ীর দিকে আসছেন । আমি আম্মুকে ডেকে নিয়ে আসলাম । আম্মু বাইরে গিয়ে তাকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসলেন । সারাদিন আমি আর নানা অনেক গল্প করলাম । নানা আবার অসুস্থ, ঘোড়া হয়ে আমাকে আর পিঠে নিয়ে টগবগ করে ছুটতে পারছেন না । আমি কিছুক্ষণ পরপর জিজ্ঞেস করছি, নানা আজকি আমরা ঘোড়া ঘোড়া খেলবনা ??? নানী এসে বললেন মানুষটাকে এত বিরক্ত করিস কেন ? তারপর পুরো দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা নানার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে কাটিয়েছিলাম ।

আম্মু আমাকে আর নানার কাছে পাঠায়না, নানা আর আমাকে নিয়ে খেলতে পারবেন না, উনি অসুস্থ । সেই ঈদের দিনটা আমার মানসপটে আজোবধি জ্বলজ্বলে । আমার ভাই কয়েকদিন আগে আম্মুর পেট ছেড়ে বাইরে বের হয়েছে ! ওকে সহ্য করতে পারছিনা, সারাক্ষণ ওকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত থাকে । নানা ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী পরে একটা মোটর গাড়ীর পেছনে বসে । আমার ভাইকে দুহাত বাড়িয়ে কোলে নিতে গেলেন তিনি । আমি আমার ভাইকে সরিয়ে নানার কো্লে বসে বলতে লাগলাম, তুমি ওকে কোলে নেবেনা, ওকে সবাই খুব আদর করে ভালবাসে আর আমাকে কেউ এখন আদর করেনা । তুমি ভাল হয়ে গেছ, আবার আমার সঙ্গে খেলবেনা ?

নানা মুচকি হেসে বললেন, তুই যখন অনেক বড় হয়ে যাবি তখন আমাকে মনে রাখবি তো রাজকন্যা ? আমি নানার কথায় অস্বীকৃতি জানিয়ে বললাম, তুমি দেখ আমি কখনোই বড় হবনা, আমি শুধু তোমার সঙ্গেই খেলব । নানা আর দেরি করেনি, গাড়ী ছেড়ে দিল ড্রাইভার ।

আম্মু আমাকে এক হাতে টেনে ধরে রেখেছেন, নানা চলে যাচ্ছে, আমি কাঁদছি । আমার ভাই এর বয়স পনের দিন । আম্মু সকাল থেকে খুব কাঁদছেন, নানাবাড়ীতে মানুষের ঢল । সবাই বলছে নানা মরে গেছে । আমি আব্বুকে জিজ্ঞেস করলাম, নানা মরলে কি কিছু হবে ? আম্মু আরও জোরে কেঁদে উঠলেন । ছোটমামাকে সবাই অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ীতে এনে মাথায় পানি ঢালছে । আমি আসলেই বুঝলাম না সবাই এরকম আচরন করছে কেন ?

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে যাচ্ছে, আমি একা একা চুপি চুপি নানাকে এঘর থেকে ওঘরে খুঁজে চলেছি । কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছেনা দেখে কাউকে জিগ্যেস করতে পারছিনা, নানা কোথায় ? পেয়ে গেলাম আব্বুকে আর জিগ্যেস ও করলাম ।

তিনি বললেন, নানাকে মাটির নিচে রেখে চলে এসেছেন, উনি আর কোনদিন উঠে আসবেন না । আমি রাগে আব্বুকে হাত পা ছুড়ে মারতে লাগলাম, আম্মুর কান্না আরও বেড়ে গেল । আজ আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, নানার রুপকথার রাজকন্যাও বড় হয়েছে । শুধু ছেলেবেলাটা ছেলেবেলায় রয়ে গেছে ।

নানাভাই প্রায় পনের বছর আগে আমাকে সাথী হারা করে চলে গেছে । আমার প্রথম সখা আমার নানাভাই, যার অনুপস্থিতি আজো আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্ন । ভালবাসি কথা টা বোঝার আগেই আমি নানার বিরহে বিরহিনী হয়ে গেছিলাম । সময় দ্রুত চলে গেছে, টের ই পায়নি । নানার সঙ্গে খড়ের গাদার উপর বসে শোনা গল্প গুলো মনে নেই, নানার চেহারা টাও স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে ম্লান হয়ে গেছে অনেকটা । কিন্তু দৃশ্য গুলো এখনো জীবন্ত মনে হয় ………………

নানার সঙ্গে কখনো যদি দেখা হয় তাহলে বলে দেব, “নানাভাই, তোমার সেই রাজকন্যা কোনদিন তোমাকে ভোলেনি, তুমি যে তার প্রথম সখা ! যেখানেই থেক, ভাল থেক !!!’’

বোঝেনা সে, বোঝেনা ...

বোঝেনা সে, বোঝেনা ...
লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ ইফাজ হাসবুল্লাহ

: এই রিমেল, দাড়া।
: কি? কিছু বলবি?
: কিছু না বললে কি তোকে এমনি ডেকেছি, আবুল।
: যা বলার দ্রুত বল , একটু পরেই আমার ফিজিয়ো ল্যাব।
: জি জনাব আমি জানি আপনার ফিজিয়ো ল্যাব আছে এবং ইহাও জানিযে কেউই ক্লাশটি করবেনা। শুধুমাত্র আতেল সমাজের অধিকর্তা রিমেল চৌধুরি ক্লাশটি করবেন।
: দেখ রিমি ফাজলামির একটা লিমিট আছে , তুই আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস।
: ওলে আমাল বাবুতা রেগে যাচ্ছেরে, চল্‌না কোথাও বসে গল্প করি। এত পড়ে কি হবে বল? পড়ালেখা করে কে পেয়েছে কিকবে?ঃ/
: ধুর, তোর মত এত আজাইরা গল্প করার সময় আমার নেই, আমি চললাম..
: রিমন গটগট করে ফিজিয়ো ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেল, সেদিকে তাকিয়ে রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ছেলেটা কি কিছুই বোঝেনা? নাকি ইচ্ছে করেই মফিজ সেজে থাকে।

রিমেলের সাথে রিমির পরিচয় মেডিকেল কোচিঙ্গে। একই সেকশনে ছিল দুজন। বেশিরভাগ পরীক্ষাতেই রিমেল সর্বোচ্চ নম্বর পেত। এক পরীক্ষায় রিমি সর্বোচ্চ পায়, আর তা দেখে রিমেলের সেকি কান্না। এই কান্নাই কাল হয়ে দাড়াল রিমির, এত্ত কিউট করে একটা ছেলে কিভাবে কাঁদে। ছেলেটার জন্য কেমন জানি করতে লাগল। সবাই চলে যাওয়ার পর্‌ও রিমেল রেজাল্ট বোর্ডের সামনে দাড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

: এই ছেলে ধর! টিশ্যু এগিয়ে দেয় রিমি। এমন ছিঁচকাদুনে ছেলেতো আমি বাপের জন্মেয় দেখিনি। এখনো ফেচফেচ করে কাঁদছে। থামবি? না কশে এক চড় লাগাব!
: আমার ইচ্ছে আমি কাঁদব, আপনার কি? জানেন, আম্মু যদি জানতে পারে আমি সেকেন্ড হয়েছি তবে আমার পিঠের চামড়া রাখবেনা!
: আহারে বুদ্ধূ, তুই বলবি তুই প্রথম হয়েছিস, তাহলেইতো হয়।
: রিমেলের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ফিক করে হেসে দিল। কি চিন্তা করে পরক্ষনেই রাজ্যের মেঘ এসে জমল। "যদি আম্মু বুঝে ফেলে? তাহলে আমি শেষ!"
: আরে বেকুব, আন্টি কিছুই বুঝবেনা। বল, অল ইজ ওয়েল.. বল বল।
: এটা আবার কি?
: কেন?? থ্রি ইডিয়টস মুভিটা দেখস নাই??
: না, আমি টিভি দেখি না। এমনকি আমাদের টিভিই নেই। মা বলেছেন, ছাত্রনং অধিয়নং তপ। না পড়লে আমি বড় হতে পারবনা, তাই আমি সারাদিন পড়ি।

রিমি মনে মনে ভাবে " কত্ত বড় হয়েছিস তাতো দেখতেই পারছি। "শুন, এখন থেকে আমি কম আনসার করব, না হলেতো আবার ফেচফেচ করে কাঁদবি। আর তুই আমাকে তুই করে বলবি, আজ হতে আমরা ফেন্দু।
: ফেন্দু?
: গান্ধা, ফেন্দু মানে হল ফ্রেন্ড, বুঝলি!
: হুম.. আচ্ছা যাইরে, দেরি করলে আবার আম্মুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে..
: রিমির চোখে বিদ্রুপের হাসি, এমন মাম্মি ড্যাডির ছেলে খুব কম দেখেছে। যাগা, আর দেখে পথ চলিস না হয় উষ্ঠা খেয়ে নাকমুখ ভাংবি। একটা স্মিত হাসি দিয়ে রিমেল চলতে শুরু করল।
: এরপর থেকে তাদের প্রায় প্রতিদিন ই দেখা হতে লাগল, ক্লাশ শেষে একসাথে ফেরা, গল্প করা। একদিন ফেরার পথে রিমি জিজ্ঞেশ করল, আচ্ছা, তুইতো অনেক কিছুই বুঝিস না, আমি বুঝিয়ে দেই। ধর রাতে পড়ার সময় একটা টপিকস বুঝছিস না, তখন কি করবি??
: পরদিন এসে তোর থেকে বুঝে নেব।
: ধর তোর ঐ মুহুর্তেই বোঝা প্রয়োজন, তখন কি করবি?
: কি করব?
: আমাকে কল দিবি।
: ওকে, তোকে কল দিব।
: কিভাবে কল দিবি?
: কেন? মোবাইল দিয়ে।
: ঊফফ, কলতো মোবাইল দিয়েই দেয়। আমার নম্বর তোর কাছে আছে?
: নাহ, নেই।
: নিবি না??
: ওহ হ্যা, বল।
: ০১৬********
: ধর, আমার দরকার হল তোকে কল করার , তাহলে আমি কি করব?
: কি করবি??
: আরে বোকচোদ নম্বর দে।
: ওউ, ০১৯********
: তুই এমন বোকা কেন বলত? কিছুই কি বুঝিস না?
: কি বুঝব?
: কিচ্ছু না। চল ফুচকা খাই।

এভাবেই চলে গেল তাদের দিনগুলো। কিছুদিন পর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে দুজন ই সি.এম.সি তে চানস পেল। গ্রীষ্ম যায়, বর্ষা যায়, বসন্ত এসে উপস্থিত। রিমি কিছুতেই তার মনের কথাগুলো বলতে পারেনা। ছেলেরা বোকা হয়, তাই বলে এত!!! নাহ তার আর সয্য হয়না। দুচোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে।

রিমন ফিজিয়ো ল্যাব এর কথা বলে ফুলেরদোকানের সামনে এসেছে। টকটকে ৫টা লালগোলাপ কিনল। রিমি মেয়েটা তাকে যতটা বোকাভাবে, সে আসলে ঠিক ততোটা নয়। রিমিকে প্রথম দেখাতেই তার ভাল লাগে। ইচ্ছেকরেই এতদিন সে অভিনয় করে এসেছে। তার বাবা বিজনেসম্যান ইংল্যান্ডে থাকে, মাকে হারিয়েছে ২ বছর বয়সে। বড় হয়েছে দাদির কাছে, মায়ের আদর সে পায়নি। তাই যখন রিমির সাথে পরিচয় হয়, তার কাছে আসার চেষ্টা করে, প্রতিটি মুহুর্তে নিজের সাজানো বাগানে রিমির ভালবাসার ফুল ফোটানর চেষ্টা করে গিয়েছে। আর তাইতো এত অভিনয়।

আজ যা হওয়ার হবে, রিমিকে তার ভালবাসার কথা বলবেই। এতদিনের সব অভিনয় প্রকাশ করে দিবে। যে ডিসিশন ইরিমি নিক, মাথা পেতে নিবে।

রিমেল মুক্তমঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। রিমি পা দুটো ভাজ করে দু'হাতের উপর মাথা দিয়ে নিচু হয়ে বসে আছে। রিমেল তার সামনে গিয়ে হাটু গেড়ে বসে।

: রিমি?
: রিমি অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকায়। চোখভর্তি জল। মুখদুটো ফুলে আছে। রিমন রিমিকে এই প্রথম কাঁদতে দেখল। মেয়েটা এমনিতেই অসাধারন রুপবতী, কান্না যেনো রুপের আগুন দ্বিগুন বাড়িয়ে দিল।

: রিমন ধীরে ধিরে পাঁচটি লাল গোলাপ রিমির সামনে মেলে ধরল।

: ঠাস!!! রিমি কশে এক চড় লাগাল।
রিমন হতভম্ব!!

: হারামি, বজ্জাত, শয়তান ছেলে, এতদিন লাগছে বুঝতে!
আহ! রিমনের বুক হতে যেন এক টন বোঝা নেমে গেল।

ধীরে ধীরে মেঘ সরে গেল, সুয্যি মামা ফিক করে হেসে দিল।
বসন্তের হিমেল হাওয়ায় কৃষ্ণচূড়ার লাল ফুলে ছাওয়া ডালগুলো দুলে উঠল।

দুরে কোথাও কোকিল গেয়ে উঠল, কুহু, কুহু, কুহু....