আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

''নিধির চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ''

''নিধির চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ''
by-শাহজাহান সিরাজ

দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। খোলার নাম ধাম নেই। রাহাতদের দরজাটায় কি কারনে যেন আজকাল ভেতর থেকে তালা লাগানো থাকে। আর কোনো এক আশ্চর্য কারনে আমি এসে নক করলেই বাড়ির মানুষগুলো চাবি খুঁজে পায় না। এখানে রেখেছিলাম,ওখানে রেখেছিলাম,একটু দাড়ান, এইতো খুলছি- জাতীয় কথাবার্তার পর কেউ একজন এসে বিব্রত মুখে দরজা খোলে। প্রতিদিনই।

আমার এই চাঁর-পাচ মিনিট কা

টে মুঠোফোনে বিনাকারনে গুতোগুতি করে। আজও সেই কাজ করছিলাম। হঠাত সেই অস্বস্তিবোধ ফিরে এলো। সেই অস্বস্তিবোধ বলার কারন হলো এই অনুভূতিটা আজ কদিন ধরেই হচ্ছে। কারন অজানা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে একটা ব্যাপার থাকে। এটাকে প্রতিদিনই কাজে লাগাচ্ছি কিন্তু ভোতা ইন্দ্রিয় কিছুতেই কূল কিনারা করতে পারছে না।

দুদিন ধরেই এদিকটায় বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। হল থেকে বেরোবার সময়ই আকাশের গোমরা মুখ দেখে এসেছিলাম। বৃষ্টি আসার কত দেরি দেখার জন্য আকাশের দিকে তাকাতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো দোতলার বারান্দায়। গ্রীলের ভেতর থেকে এদিকেই তাকিয়ে আছে হরিনের মতো সজল দুটো চোখ। থমকে গেলাম । স্তব্ধ-আড়ষ্ট-অভিভূত হয়ে গেলাম। ও চোখেই দেখে নিলাম আমার সর্বনাশ।

- স্যার। আসুন। দরজা খুলে গেছে খেয়ালই করি নি। রাহাতের কন্ঠ কানে যেতেই যেন পৃথিবীতে ফিরে এলাম।
- ও হ্যা। চল। বলে আবার উপরে তাকালাম। নেই। হরিনী নিরুদ্দেশ।

**

হরিনীর পরিচয় আমার পেতেই হবে। কিন্তু কিভাবে ? স্টুডেন্টকে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করে বসবো? যদি কিছু ভেবে বসে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাত মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো।

- নতুন কিছু পড়াবো না আজ। তোমার ফ্রি হ্যান্ড রাইটিং দেখবো। রাইট আ প্যারাগ্রাফ এবাউট ইউর ন্যেইবার ! ইন ডিটেইলস !!
- ওকে স্যার। কিন্তু আপনি এসিস্ট করবেন।
- তা করা যাবে। কিন্তু তুমি অবশ্যই প্রত্যেকের ব্যাপারে ডিটেইলস লিখবা। তোমাদের উপর তলার ন্যেইবারদের নিয়েই নাহয় লিখো।

স্টুডেন্ট এর প্যারাগ্রাফে হরিনীর ব্যাপারে দুটি তথ্য পেলাম। নাম নিধি। দুদিন বাদেই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা।

এরপর নিধির সাথে প্রতিদিনই দেখা হতো। আমি রাহাতদের দরজায় নক করে উপরে তাকালেই নিধিকে দেখতে পেতাম। রাহাতকে পড়ানো শেষ করে বেড়িয়ে যাবার সময় এটা পড়ে রাখবা, ওটা পড়ে রাখবা, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় আসবো ইত্যাদি কথা বলতাম জোড়ে জোড়ে। আপ্রান চেষ্টা থাকতো আমার গলার স্বর যেন ওপরতলায় পৌছায়। নিধি যেন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়!

আমার এরুপ দায়িত্বশীলতা থেকেই কিনা কে জানে জীবনে প্রথমবার ভাগ্যটাকে নিয়ে আহ্লাদ করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। রাহাতে আম্মু একদিন ড্রয়িং রুমে এসে বললো

- আমাদের বাড়িওলার এক মেয়ে আছে। সামনে ওর এইচেসসি ফাইনাল। আপনি কি ওকে কদিন অংক দেখাতে পারবেন? বাড়িওলার ইচ্ছা এমনই।

- জী আন্টি অবশ্যই। বলেই বুঝলাম যত দ্রুত উত্তর দিলাম তত দ্রুত বোধহয় মাধ্যাকর্ষন ভাঙ্গার জন্য রকেটকেও আজকাল ছুটতে হয় না । আন্টির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম উনি আমার শর চেষ্টায় আটকে রাখা খুশিটা ধরে ফেলেছেন কিনা।
**
নিধিকে পড়াতেগিয়ে দুটো বিষয় আবিস্কার করলাম। এক, মেয়েটি বোবা। দুই, তাকে ছাড়া আমার পক্ষে বাঁচা সম্ভব না। ওর পাখির নীড়ের মতো গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বলতে ইচ্ছে করতো- তোমাকে চাই। কিছু না বুঝলে ও যখন দু-ঠোট ফুলিয়ে মাথা এদিক-ওদিক নাড়তো তখনো বলতে ইচ্ছে করতো -'তোমাকে চাই!' কিছু বোঝানোর সময় গভীর মনোযোগে যখন ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকতো তখনও বলতে ইচ্ছে করতো- 'তোমাকেই চাই।' নিধিও কি আমাকে চাইতো না?

নিধির বাবা মা অবশ্য আমাকে ভীষন চাইতো। প্রতিদিন এক ঘন্টার যায়গায় দু ঘন্টা পড়ালে এটা হওয়াটাইতো স্বাভাবিক। আমি প্রতিদিন চেষ্টা করতাম নিধিকে মনের কথাটা বলে ফেলতে। পকেটে চিঠিটা ছিলো একেবারে প্রথম দিন থেকেই। বের করাটাই হয়ে ওঠেনি।

**
আজ নিধিদের বাসায় আমার শেষ দিন। দুদিন বাদে ওর পরীক্ষা তাই আমার আর আসার প্রয়োজন হবে না। আজ যদি বলতে না পারি আর হয়তো কখনোই বলা হবে না। তিরিশ মিনিট ধরে বলার চেষ্টা করছি। মুখ খুলছি। হাত নাড়ছি।থেকে যাচ্ছি। এতটা অপ্রস্তুত কখনোই লাগে নি নিজেকে। নিধিও অপ্রস্তুত আমার এমন আচরনে। বলেই বসলাম শেষমেষ। স্নায়বিক উত্তেজনায় একটু বোধ হয় জোড়েই বলে বসলাম। নাহলে এই ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দা থেকে নিধির মা সাথে সাথে উঠে আসবেন কেন? কপাল! আমি কি আর জানতাম ওখানে বসে গত একমাস ধরে তিনি আমাদের পাহারা দেন !!

ফলাফল হলো ভয়াবহ। আমাকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে ভদ্রভাষায় বের করে দেয়া হলো। তারচেয়েও ভদ্রভাষায় রাতে ফোন করে রাহাতের মা জানালেন আমার আর আপাতত ওদিকটায় যাওয়ার দরকার নেই। শেষ সম্বল টিউশনি দুটো হারিয়ে আমি তখন দুচোখে অন্ধকার দেখছি। এরপরেও যে নিধিকে একবার দেখার আশায় নিধিদের বাসার সামনের রাস্তাটায় যাইনি এমন তো নয়। কিন্তু বারান্দায় আর তাকে দেখা পাই নি। একসময় হাল ছেড়ে দিলাম। নিজেকে স্বান্তনা দিলাম এই ভেবে যে- আমার এই অনিশ্চয়তা মাখা জীবনে নিধিকে আর নাই-বা জড়ালাম।
**
তিনবছর পর আজ হঠাত সেদিনের কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো সেই দিনটির কথাও যেদিন নিধি রাহাতের কাছে ঠিকানা নিয়ে আমার হল পর্যন্ত চলে এসেছিলো। সেদিন কি কাপুরুষের মতো ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসাটা ঠিক ছিলো না?

সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির রাস্তাটায় মোড় নিয়েছি। হর্ন বাজাতেই গেট খুলে গেলো। গাড়িটা কোনোরকম গ্যারেজে রেখেই দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। গ্যারেজ থেকে দরজার রাস্তাটাও আমি পার হই রকেট গতিতে। শুধু তার কারনে । দোতালার বারান্দা থেকে যে প্রতিদিন তাকিয়ে থাকে গভীর মায়াভরা চোখে। যার চোখে একদিন দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।

''অবশেষ''

''অবশেষ''
By- AnkOn's ShatkahOn

চাকরিটা হয়েই গেল!
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েও বিশ্বাস হচ্ছিল না পান্নার। সে আগে বারবার করে খুঁটিয়ে কাগজে টাইপ করা কালো অক্ষরে নিজের নামটা দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল ভুল করে হয়ত অন্য কারো চিঠি তার কাছে এসে পড়েছে। সে বারকয়েক চোখ ডলে হাতে চিমটি কেটেও যখন চিঠির নামটা হাওয়ায় মিলিয়ে না গিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল- তখন তার বোধগম্য হল আসলেই সে চাকরীটা পেয়েছে


টু হুম এট ম...ে কনসার্ন... বার তিনেক পুরো চিঠিটাই পড়ল সে। আহামরি কোন ব্যাপার নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে আটটা-পাঁচটা কাগজে কলম ঘষার চাকরী। তবে সুবিধা আছে বেশ। ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, দুপুরের লাঞ্চ, সাথে মাস শেষে পনের হাজার টাকার মোটাতাজা বান্ডিল আর বছরে দু’বার বোনাস। আর কি চাই!
টানা আট মাসের বেকারত্বের পর এহেন প্রোপোজাল পেয়ে পান্নার মুখে বেশ বড়সড় এক টুকরো হাসি ফোটার কথা। কিন্তু তার ঠোঁটের এককোণে এক চিলতে বিদ্রুপের হাসি ছাড়া তার মধ্যে আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না!

চাকরীটা তার বড় দরকার ছিল। তবে যতটা না এখন তার চেয়ে আরো বেশি দরকার ছিল আরো মাস চারেক আগে।
সেদিনটার কথা আজো মনে পড়ে যখন বৃষ্টির দিকে তাকানোরও সাহস ছিল না ওর। সারাদিন শহরের অফিসপাড়ায় ঘোরা আর রাতের আঁধারে মুখখানা আঁধারের চেয়ে কালো করে ঘরে ফেরাই ছিল প্রাত্যাহিক রুটিন। দিনের বেলা শূন্য পকেটে হাঁটার ক্লান্তি আর খিদে ভোলার সাথী হত ওয়াসার কলের পানি। কখনো দু’টাকা পকেটে থাকলে একটা সিংগারা।
তবে রাতে ক্লান্তি-খিদের সাথে যুক্ত হত লজ্জাও। নিজে না খেয়ে থাকাটা যদিও বা সহনীয়, কিন্তু বৃষ্টির মলিন আশাহত মুখখানা দেখে মনে হত বুকের কলিজাটা বুঝি কেউ হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিচ্ছে। আর মিষ্টির চেহারা দেখলে আত্মহত্যার একটা তুমুল ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইত।
মিষ্টি পান্নার পাঁচ বছরের শিশুকন্যা।
ওর নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে ও অশ্রুসজল চোখে ভাবত কেন রে তুই এই অধমের ঘরে এলি রে মা! তোকে আরাম আয়েশ তো দূরের কথা ঠিকমত খাওয়াটা দেয়াও যে এই বাপের কপালে নেই। সে সব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও পান্নার মাথায় আগুন জ্বলে।

দোষ তেমন কিছুই ছিল না পান্নার। বেশ খাসা সরকারী চাকরি সাথে ভালবেসে বিয়ে করা তার অতি আদরের বৃষ্টি। প্রেমের বিয়েটা দুজনের পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি, তাই দুজনেই মিলে ছিল তাদের সাজানো সংসার। সারাদিন হাজারটা দুষ্টুমী আর হাসিখেলায় ভরপুর একটা স্বর্গ যেন। সেই স্বর্গ আলো করে যখন মিষ্টি এল তাদের খুশি দেখে কে? মিষ্টি আর পান্না দুজনের দস্যিপনা সামলাতেই সারাদিনমান ব্যতিব্যস্ত থাকত বৃষ্টি। আর সেটাই ছিল ওর জগত। একেবারে নিজের জগত। যা তার আপনার মনের মত করে রচিত।

কিন্তু, সুখের সময় থাকে কদ্দিন? অফিসের চারপাশে অনিয়মের পাহাড় দেখে মন বিষিয়ে ওঠে পান্নার। একদিন তাই কোন কুক্ষনে নালিশ করে বসে তার সহকর্মী মনসুর সাহেবের নামে যিনি কিনা টেবিলের নিচের আদান প্রদানে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারপর কি থেকে কি হয়ে গেল! এনকোয়ারীতে পান্নার ব্যাগের ভেতর আবিষ্কৃত হল নোটের তাড়া। আর তাতেই পান্নার চাকরী তো গেলই, সাথে ছ’মাসের জেল। যতটা না আঘাত লাগল পান্নার তার ব্যথা বেশির ভাগটাই যেন গিয়ে পড়ল বৃষ্টির কাঁধে। চোরের বউয়ের অপবাদ সাথে সংসারের বোঝা সব মিলিয়ে বিষময় ছ’টা মাস কি করে যে গেল- বৃষ্টির সে কাহিনী বুঝি আজ স্বয়ং বৃষ্টিও জানেনা।

পান্না যখন ফিরল যেন আশাও ফিরল তার। এবার তার দুঃখের সময় ঘুচল বলে। কিন্তু, কিছুদিনেই প্রতীয়মান হয়ে গেল আসলে একটা মুখ বাড়ল মাত্র। আয় কানাকড়িও না। নানা অফিসে, বন্ধু-বান্ধব, ইন্টারনেট, পত্রিকা সবজায়গায় ধর্না দিল পান্না। ফলাফল শূন্য। চোরকে চাকরি দিতে রাজী হলনা কেউই। সঞ্চয় যেটুকু ছিল তাও তখন শূন্যের কোটায়। একটা চাকরীর জন্য তখন পাগলপ্রায় দশা ছিল পান্নার। তবু পাওয়া হয়নি সেই প্রার্থিত চাকরী নামের সোনার হরিণ।

এরমধ্যেই একদিন বাসায় ফিরে দেখল পূর্ণ হয়েছে ষোল কলা। তার পুরো পৃথিবীটাকে শূন্য করে বৃষ্টি চলে গেছে মিষ্টিকে সাথে করে! বিশ্বাস হচ্ছিল না পান্নার কিছুতেই। বৃষ্টির রেখে যাওয়া ফুটনোটটা বারবার চোখের সামনে নিয়ে পড়ে পড়ে নিজেকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে পান্না।
বৃষ্টির সেই চিরপরিচিত হাতের লেখা যা পেলে একসময় সে আহ্লাদে আটখানা হত। আজ শুধু পার্থক্য এটুকুই আগে সে লিখত তার হৃদয়ের ভালবাসার আক্ষরিক বহিঃপ্রকাশ। আর এখন যেটা রেখে গেছে তা হচ্ছে বৃষ্টির অসীম ধৈর্য্যের অবসানে তার হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপ মাত্র।

সে লিখেছে,
পা্ন্না,
জগতে যেটুকু ভালো আমি তোমায় বেসেছি তা বোধহয় কখনো আমি নিজেকেও বাসিনি। তুমি যখন থেকে আমার জীবনে এলে যেন তুমিই হলে আমার পৃথিবী। তোমার মাঝেই আমি খুঁজে নিয়েছি আমার ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত। আজো হঠাৎ আনমনে তোমার কথা মনে পড়লে তোমার ছবিতে আমি হাত বুলাই। সেই ছবিটা তোমার মনে আছে? আমাদের হানিমুনে তোলা নীলগিরির পাহাড়চূড়ায়? তুমি তখন মাত্র ঘুম থেকে জেগেছিলে। আর আমি ক্যামেরা হাতে তৈরী্ তোমার সেই ঘুমঘুম মাখা ছবি যতবারই দেখি ততবারই যেন তোমাকে নুতন করে ভালোবাসি আমি।
কিন্তু আবেগ আর বাস্তবতা পরস্পর বিপরীতার্থক শব্দ। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, নারী তার স্বামীর জন্য পৃথিবী থেকে পারে মুখ ফেরাতে; আবার সেই নারীই তার সন্তানের জন্য পারে স্বামীর থেকে মুখ ফেরাতে।
পান্না, তুমি আমি যদি হতাম শুধু তোমার এই অসহায়ত্বে আমার কোন অভিমানই থাকত না। আমি তোমার সাথে তোমার মত করেই থাকতাম সুখ দুঃখের সমভাগী হয়ে। কিন্তু, এখন এর সাথে জড়িয়ে আছে আমার মেয়েরও ভবিষ্যত। এখানে এই অভাবের আগুনে পুড়ে আমার মেয়ের জীবনকে ধুকে ধুকে কয়লায় পরিণত হওয়াটা আমি মা হয়ে সহ্য করতে পারি না।

তাই এখানেই আমার দৈন্যতা। তাই আমার চলে যেতেই হচ্ছে। ভেবোনা হাসিমুখে যাচ্ছি আমি, নিয়ে যাচ্ছি একবুক হাহাকার আর তুমিহীন শূন্যতা। তবু ফেরার উপায় নেই আমার। আমি সে শুধুই পত্নী নই। আমি যে মা। ভালো থেকো। নিজের প্রতি আমার মত করে খেয়াল রেখো।

ইতি
বৃষ্টি।

অন্ধকারে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আরেকবার মোবাইলের স্বল্প আলোয় চিঠিখানা পড়ল পান্না। চোখ বেয়ে কখন যে আবার অঝোরে বর্ষণ শুরু হয়েছে খেয়াল করেনি ও। চিঠিখানা পকেটে ঢুকিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আজ বৃষ্টি থাকলে দারুণ খুশি হত।

হয়ত সবাই মিলে বাইরে খেতে যাওয়া হত অনেকদিন পর। মিষ্টি অনেক খুশি হত। এবছর ওকে স্কুলেও ভর্তি করানো হত। হাসিমুখে আলতো হেসে ও স্কুলে যেত। পান্না হয়তো ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেত। অফিস থেকে এলে বৃষ্টি আর মিষ্টি দু’চোখের দুই মণি একসাথে দরজা খুলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হয়ত। হয়ত দুজনেই বায়না ধরত এক চকলেটের। রাতে শোয়ার সময় হলে দুই পাগলীই হয়ত মাথা রেখে ঘুমাত ওর বুকে। ওর চোখ বড় জ্বালা করছে। কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পারেনি গত চারটি মাসে, আজ তো পারার প্রশ্নই আসে না।

জানার চেষ্টা করেছে অনেক, খোঁজারও। কোথাও পায়নি ওর কলিজার টুকরো দুটোকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাকে এখন বড় ভারি মনে হচ্ছে পকেটে। কোন মূল্যই নেই আর এখন ওটার পান্নার কাছে। নিমিষেই বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে সেটা ও আর ছুঁড়ে দেয় গজৃনরত সাগরে। কিছুক্ষণ পর সেও ওই আঁধারেই সমর্পণ করবে নিজেকে চিরতরে। আজ সে বাসনাতেই এসেছে এখানে ও।

তবে কিছুক্ষণ সময় নিচ্ছে সে। কোন তাড়া নেই তার। হাতে আছে অনন্ত সময়। কোন পিছুটান নেই। নেই কোন মায়ার বাঁধন। আজ তার সলিল সমাধির সংবাদটুকুও হয়ত কখনো পাবেনা কেউ। তবু শেষ কিছুটা সময় ওই দুটো মুখ ভাবতে বড় ভাল লাগছে ওর। হৃদয় মোচরানো এক ভাললাগা যা কেবল বুকে রক্তই ঝরায়, আর চোখে প্লাবন।

অবশেষে খানিকটা ধাতস্হ হয়ে দাঁড়ায় পান্না। সময় হয়ে গেছে। যা করার এখনই করতে হবে। সে মনস্হির করে অন্তিম প্রয়াণের জন্য প্রস্তুত হল।
লাফ দিতে যাবে এমনই সময়…………

পকেটের গহীন থেকে হঠাৎ বৃষ্টির শব্দে তার কান ভারি হয়ে উঠল। বৃষ্টির নিজের হাতে সেট করা রিংটোন। শুধুমাত্র ওর ফোন এলেই টোনটা বাজে। পান্না তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে কানে লাগায়-

ওপাশ থেকে- হ্যালো বাপি… বলে ওঠে মিষ্টি।
পান্নার মনে হয় সারা শরীরে বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে। রক্তের চাপ বেড়ে যায় শতগুন। সে কান্নাগলায় বলে ওঠে মা রে....
মিষ্টি তখন বলছে, বাপি আমি কাল আসছি।

পান্না নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।
অপরপ্রান্তে তখন বৃষ্টির গলা পাওয়া যায়, পারলাম না। তোমাকে ছাড়া আমি তো আমি তোমার মেয়েটাও থাকতে পারে না। বুঝি আমি যতটা না ভালবাসি তোমায় তার চেয়েও অনেক বেশি বাসে ও।

পান্না এখনও কাঁদছে।
এ কান্না দুঃখের নয়, পরাজয়ের নয়, গ্লানির নয়। সে হাত দিয়ে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আরেকবার। মোবাইলের আলোতে দেখে সেটা চিঠি নয়, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। একই পকেটে থাকার কারণে অন্যমনস্কতায় ও চিঠিটাই ছিঁড়ে ফেলেছে।

থাক, ভালোই হয়েছে।
দুঃখের স্মৃতি না থাকাই ভালো।
পান্না একবুক আশা নিয়ে ভোরের অপেক্ষা করে। নুতন জীবনের নুতন ভোর।

মান অভিমান দুষ্টুমি (বাবু-পিচ্চি)

মান অভিমান দুষ্টুমি (বাবু-পিচ্চি)
By- জল রং

আমার সাথে পিচ্চির ঝগড়া নতুন কিছু না। প্রতিনিয়তই হয়। ঝগড়া করতেও একটা মজা আছে। ইচ্ছে করেই ঝগড়া করি ওর সাথে (যদিও ব্যাপারটা পিচ্চি জানে না) কারন, ঝগড়া সময় ও আমাকে অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়।পিচ্চির বকা খেতে খারাপ লাগে না, আমি বরং এ ব্যাপারটা খুব উপভোগ করি। ও বকা দেয় আর আমি হাসি। শব্দহীনভাবে হাসার চেষ্টা করি। কিন্তু মাঝে মাঝে হো হো করে হেসেই ফেলি। আর উনি র

াগে গজগজ করতে থাকে। আসলে ওর মুখে এতো বকা ঝকা মানায় না। যে মানুষটা তার হাসি দিয়েই আমাকে মোহিত করে রাখে তার মুখে বকাটা যেন বড্ড বেশি বেমানান। মাঝে মাঝে রাগ করে বলে “যাও তমার সাথে আর কথাই নাই”। আমি জানি ও আমার সাথে রাগ করে ৫ মিনিটও আমার সাথে টিক্তে পারবে না।লক্ষ্মী মেয়ের মতো একটু পরেই এসে বলবে,

--“নাহ, বলদের সাথে রাগ করে লাভ নেই। বলদ তো বলদই।’’
আমি আবার হেসে উঠি।
--“বলদ বলেন আর যাই বলেন বলদটা কিন্তু আপনার ই, হা হা হা”।
--হাসবি না কুত্তা। থাবড়া দিয়া তোর দাত সব ফালাই দিবো।
--আচ্ছা দেন। কোন গালে দিবেন? ডান নাকি বাম ?
--এতো প্যাঁচাল পারস ক্যান? হিলের বাড়ি খাবি?
--ছি ছি বেয়াদব মেয়ে!! জামাই পেটাতে চায়!!!
--তুই আমার জামাই হইলি কবে রে??
--আরে বিয়ে তো আমাকেই করবে। তাই এডভান্স ডাকছি আর কি।
--যা তো ভাগ। আমার তো আর কাজ নাই যে তোর মত একটা ষ্টুপিডকে বিয়ে করব।
--আমাকেই করতে হবে। আমার মতো পাত্রআর পাইবা না। আফটার অল আমি তো তোমায় ভালোবাসি
--ভালোবাস না তো ছাই। আমাকে শুধু কাঁদাও।
--আমিও কি কম কাঁদি??? তুমি যে বারবার মরার কথা বলো।
--ভুল তো বলি নি। যদি সত্যিই মারা যাই???
--দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।

কথাটা বলেই আমি লাইনটা কেটে দিলাম। নাহ, এভাবে আর হচ্ছে না। ওকে একটু মজা দেখানো দরকার।
তখন শীতকাল ছিলো, “আম্মুকে বললাম, আম্মু খেলতে যাচ্ছি। একঘণ্টার মাঝেচলে আসব”। আম্মুর অনুমতি পেয়েই আমি আমার ব্যাডমিন্টনের রেকেট হাতে আর কালো জ্যাকেটটা গায়ে জরিয়ে বেরিয়ে পরলাম। শীতের রাতে রাস্তায় লোকজন খুব কম ছিলো, রিকশাও নেই। অগত্যা হেঁটেই রউনা হলাম আমার বদমাশ পিচ্চিটার বাসায়।

রাগ করে ফোন কেটেছিলাম বলে পিচ্চি বারবার ফোন দিচ্ছিলো। আমিও বারবার কেটে দিচ্ছিলাম। ১৫ মিনিট পর আমি পিচ্চিদের বাসার সামনে। ফোন দিলাম ওকে,

--হ্যালো!!! কই ছিলা তুমি?? ফোন কেটে দিচ্ছিলা যে?
--নিচে নামেন। কথা আছে।
--মানে?
--নামো তাড়াতাড়ি।
(ওর রুমের জানালার পর্দাটা নড়ে উঠলো। বুঝলাম ও আমাকে দেখেছে। এক্ষুনি নিচে আসবে।)

--তুমিইইইইইইইইইইই এখানে কি করছো!!!!!!! কেই দেখলে তো সর্বনাশ।
--আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলবো। বলবো যে আপনার মেয়ে শুধু আমাকে কাঁদায়। আমাকে বলে সে নাকি মারা যাবে।
--বাবার সাথে কথা বলতেযাবে?সাহস আছে? ত যাও বাবার সাথে কথা বলো।
(ও ভেবেছিলো আমি হয়ত ওর সাথে মজা করছি। আমি সত্যিই সিঁড়ী বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।
ও আমার হাত ধরে ফেললো )
--আরে তুমি দেখি পাগল হয়ে গেছ। আব্বু জানলে তো সব শেষ।
--তুমিই তো বারবার সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছ। মরার কথা কেন বলো তুমি ? আমার কি খারাপ লাগে না!!!
( কথাটুকু বলেই আমি কেঁদে দিলাম )
--এই যে কান ধরলাম আর কখনো বলবো না এমন কথা ।তুমি কেঁদ না প্লিজ। দেখি তো এদিকে তাকাও।
(ওড়না দিয়ে আমার চোখ মুছে দিলো)
--:’(
--কেঁদো না আমার বাবুটা।
--হুম। আজকের কথাটা যেন মনে থাকে।
--অবশ্যই। এখন বাসায় যাও।
--একটা কথা বলবো ???
--হ্যা বলো।
--তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।
--বদ পোলা!! ভাগ এখান থেকে।
--আচ্ছা।
(আমি উল্টো ঘুরে চলে যাচ্ছিলাম। এমনসময় পেছন থেকে ও ডাক দিলো।)
--এই শোন

আমি পেছন ফিরতেই কোমল দুটি হাত আমাকে জড়িয়ে নিলো শক্ত করে।আমিও খুব শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম আমি। আমার কানএ কানে ও বললো, “I love u babu,এভাবে আমাকে আগলে রেখ সারাজীবন”
মানুষ যে কতটা আনন্দে,কতটা ভালোলাগায় কাঁদতে পারে তা বুঝতে পারলাম। দুচোখের জল অস্থির হয়ে গেলো। আমিও ওর কানে কানে বলাম, “I love u so much picci” বলেই কেঁদে দিলাম।

পিচ্চি বললো, “আবার কাঁদছো!!!!! দাঁড়াও কাল রাতে আমি তোমার বাবার সাথে কথা বলতে যাব”

এবার দুজনেই হেসে উঠলাম।