আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

''অবশেষ''

''অবশেষ''
By- AnkOn's ShatkahOn

চাকরিটা হয়েই গেল!
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে পেয়েও বিশ্বাস হচ্ছিল না পান্নার। সে আগে বারবার করে খুঁটিয়ে কাগজে টাইপ করা কালো অক্ষরে নিজের নামটা দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল ভুল করে হয়ত অন্য কারো চিঠি তার কাছে এসে পড়েছে। সে বারকয়েক চোখ ডলে হাতে চিমটি কেটেও যখন চিঠির নামটা হাওয়ায় মিলিয়ে না গিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল- তখন তার বোধগম্য হল আসলেই সে চাকরীটা পেয়েছে


টু হুম এট ম...ে কনসার্ন... বার তিনেক পুরো চিঠিটাই পড়ল সে। আহামরি কোন ব্যাপার নয়। একটা প্রাইভেট ফার্মে আটটা-পাঁচটা কাগজে কলম ঘষার চাকরী। তবে সুবিধা আছে বেশ। ট্রান্সপোর্ট সুবিধা, দুপুরের লাঞ্চ, সাথে মাস শেষে পনের হাজার টাকার মোটাতাজা বান্ডিল আর বছরে দু’বার বোনাস। আর কি চাই!
টানা আট মাসের বেকারত্বের পর এহেন প্রোপোজাল পেয়ে পান্নার মুখে বেশ বড়সড় এক টুকরো হাসি ফোটার কথা। কিন্তু তার ঠোঁটের এককোণে এক চিলতে বিদ্রুপের হাসি ছাড়া তার মধ্যে আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না!

চাকরীটা তার বড় দরকার ছিল। তবে যতটা না এখন তার চেয়ে আরো বেশি দরকার ছিল আরো মাস চারেক আগে।
সেদিনটার কথা আজো মনে পড়ে যখন বৃষ্টির দিকে তাকানোরও সাহস ছিল না ওর। সারাদিন শহরের অফিসপাড়ায় ঘোরা আর রাতের আঁধারে মুখখানা আঁধারের চেয়ে কালো করে ঘরে ফেরাই ছিল প্রাত্যাহিক রুটিন। দিনের বেলা শূন্য পকেটে হাঁটার ক্লান্তি আর খিদে ভোলার সাথী হত ওয়াসার কলের পানি। কখনো দু’টাকা পকেটে থাকলে একটা সিংগারা।
তবে রাতে ক্লান্তি-খিদের সাথে যুক্ত হত লজ্জাও। নিজে না খেয়ে থাকাটা যদিও বা সহনীয়, কিন্তু বৃষ্টির মলিন আশাহত মুখখানা দেখে মনে হত বুকের কলিজাটা বুঝি কেউ হাতের মুঠোয় নিয়ে চাপ দিচ্ছে। আর মিষ্টির চেহারা দেখলে আত্মহত্যার একটা তুমুল ইচ্ছে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইত।
মিষ্টি পান্নার পাঁচ বছরের শিশুকন্যা।
ওর নিষ্পাপ মুখখানার দিকে তাকিয়ে ও অশ্রুসজল চোখে ভাবত কেন রে তুই এই অধমের ঘরে এলি রে মা! তোকে আরাম আয়েশ তো দূরের কথা ঠিকমত খাওয়াটা দেয়াও যে এই বাপের কপালে নেই। সে সব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও পান্নার মাথায় আগুন জ্বলে।

দোষ তেমন কিছুই ছিল না পান্নার। বেশ খাসা সরকারী চাকরি সাথে ভালবেসে বিয়ে করা তার অতি আদরের বৃষ্টি। প্রেমের বিয়েটা দুজনের পরিবারের কেউই মেনে নেয়নি, তাই দুজনেই মিলে ছিল তাদের সাজানো সংসার। সারাদিন হাজারটা দুষ্টুমী আর হাসিখেলায় ভরপুর একটা স্বর্গ যেন। সেই স্বর্গ আলো করে যখন মিষ্টি এল তাদের খুশি দেখে কে? মিষ্টি আর পান্না দুজনের দস্যিপনা সামলাতেই সারাদিনমান ব্যতিব্যস্ত থাকত বৃষ্টি। আর সেটাই ছিল ওর জগত। একেবারে নিজের জগত। যা তার আপনার মনের মত করে রচিত।

কিন্তু, সুখের সময় থাকে কদ্দিন? অফিসের চারপাশে অনিয়মের পাহাড় দেখে মন বিষিয়ে ওঠে পান্নার। একদিন তাই কোন কুক্ষনে নালিশ করে বসে তার সহকর্মী মনসুর সাহেবের নামে যিনি কিনা টেবিলের নিচের আদান প্রদানে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তারপর কি থেকে কি হয়ে গেল! এনকোয়ারীতে পান্নার ব্যাগের ভেতর আবিষ্কৃত হল নোটের তাড়া। আর তাতেই পান্নার চাকরী তো গেলই, সাথে ছ’মাসের জেল। যতটা না আঘাত লাগল পান্নার তার ব্যথা বেশির ভাগটাই যেন গিয়ে পড়ল বৃষ্টির কাঁধে। চোরের বউয়ের অপবাদ সাথে সংসারের বোঝা সব মিলিয়ে বিষময় ছ’টা মাস কি করে যে গেল- বৃষ্টির সে কাহিনী বুঝি আজ স্বয়ং বৃষ্টিও জানেনা।

পান্না যখন ফিরল যেন আশাও ফিরল তার। এবার তার দুঃখের সময় ঘুচল বলে। কিন্তু, কিছুদিনেই প্রতীয়মান হয়ে গেল আসলে একটা মুখ বাড়ল মাত্র। আয় কানাকড়িও না। নানা অফিসে, বন্ধু-বান্ধব, ইন্টারনেট, পত্রিকা সবজায়গায় ধর্না দিল পান্না। ফলাফল শূন্য। চোরকে চাকরি দিতে রাজী হলনা কেউই। সঞ্চয় যেটুকু ছিল তাও তখন শূন্যের কোটায়। একটা চাকরীর জন্য তখন পাগলপ্রায় দশা ছিল পান্নার। তবু পাওয়া হয়নি সেই প্রার্থিত চাকরী নামের সোনার হরিণ।

এরমধ্যেই একদিন বাসায় ফিরে দেখল পূর্ণ হয়েছে ষোল কলা। তার পুরো পৃথিবীটাকে শূন্য করে বৃষ্টি চলে গেছে মিষ্টিকে সাথে করে! বিশ্বাস হচ্ছিল না পান্নার কিছুতেই। বৃষ্টির রেখে যাওয়া ফুটনোটটা বারবার চোখের সামনে নিয়ে পড়ে পড়ে নিজেকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে পান্না।
বৃষ্টির সেই চিরপরিচিত হাতের লেখা যা পেলে একসময় সে আহ্লাদে আটখানা হত। আজ শুধু পার্থক্য এটুকুই আগে সে লিখত তার হৃদয়ের ভালবাসার আক্ষরিক বহিঃপ্রকাশ। আর এখন যেটা রেখে গেছে তা হচ্ছে বৃষ্টির অসীম ধৈর্য্যের অবসানে তার হৃদয়ের ধ্বংসস্তূপ মাত্র।

সে লিখেছে,
পা্ন্না,
জগতে যেটুকু ভালো আমি তোমায় বেসেছি তা বোধহয় কখনো আমি নিজেকেও বাসিনি। তুমি যখন থেকে আমার জীবনে এলে যেন তুমিই হলে আমার পৃথিবী। তোমার মাঝেই আমি খুঁজে নিয়েছি আমার ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যত। আজো হঠাৎ আনমনে তোমার কথা মনে পড়লে তোমার ছবিতে আমি হাত বুলাই। সেই ছবিটা তোমার মনে আছে? আমাদের হানিমুনে তোলা নীলগিরির পাহাড়চূড়ায়? তুমি তখন মাত্র ঘুম থেকে জেগেছিলে। আর আমি ক্যামেরা হাতে তৈরী্ তোমার সেই ঘুমঘুম মাখা ছবি যতবারই দেখি ততবারই যেন তোমাকে নুতন করে ভালোবাসি আমি।
কিন্তু আবেগ আর বাস্তবতা পরস্পর বিপরীতার্থক শব্দ। বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, নারী তার স্বামীর জন্য পৃথিবী থেকে পারে মুখ ফেরাতে; আবার সেই নারীই তার সন্তানের জন্য পারে স্বামীর থেকে মুখ ফেরাতে।
পান্না, তুমি আমি যদি হতাম শুধু তোমার এই অসহায়ত্বে আমার কোন অভিমানই থাকত না। আমি তোমার সাথে তোমার মত করেই থাকতাম সুখ দুঃখের সমভাগী হয়ে। কিন্তু, এখন এর সাথে জড়িয়ে আছে আমার মেয়েরও ভবিষ্যত। এখানে এই অভাবের আগুনে পুড়ে আমার মেয়ের জীবনকে ধুকে ধুকে কয়লায় পরিণত হওয়াটা আমি মা হয়ে সহ্য করতে পারি না।

তাই এখানেই আমার দৈন্যতা। তাই আমার চলে যেতেই হচ্ছে। ভেবোনা হাসিমুখে যাচ্ছি আমি, নিয়ে যাচ্ছি একবুক হাহাকার আর তুমিহীন শূন্যতা। তবু ফেরার উপায় নেই আমার। আমি সে শুধুই পত্নী নই। আমি যে মা। ভালো থেকো। নিজের প্রতি আমার মত করে খেয়াল রেখো।

ইতি
বৃষ্টি।

অন্ধকারে বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আরেকবার মোবাইলের স্বল্প আলোয় চিঠিখানা পড়ল পান্না। চোখ বেয়ে কখন যে আবার অঝোরে বর্ষণ শুরু হয়েছে খেয়াল করেনি ও। চিঠিখানা পকেটে ঢুকিয়ে সাগরের দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। আজ বৃষ্টি থাকলে দারুণ খুশি হত।

হয়ত সবাই মিলে বাইরে খেতে যাওয়া হত অনেকদিন পর। মিষ্টি অনেক খুশি হত। এবছর ওকে স্কুলেও ভর্তি করানো হত। হাসিমুখে আলতো হেসে ও স্কুলে যেত। পান্না হয়তো ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেত। অফিস থেকে এলে বৃষ্টি আর মিষ্টি দু’চোখের দুই মণি একসাথে দরজা খুলে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত হয়ত। হয়ত দুজনেই বায়না ধরত এক চকলেটের। রাতে শোয়ার সময় হলে দুই পাগলীই হয়ত মাথা রেখে ঘুমাত ওর বুকে। ওর চোখ বড় জ্বালা করছে। কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পারেনি গত চারটি মাসে, আজ তো পারার প্রশ্নই আসে না।

জানার চেষ্টা করেছে অনেক, খোঁজারও। কোথাও পায়নি ওর কলিজার টুকরো দুটোকে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটাকে এখন বড় ভারি মনে হচ্ছে পকেটে। কোন মূল্যই নেই আর এখন ওটার পান্নার কাছে। নিমিষেই বের করে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে সেটা ও আর ছুঁড়ে দেয় গজৃনরত সাগরে। কিছুক্ষণ পর সেও ওই আঁধারেই সমর্পণ করবে নিজেকে চিরতরে। আজ সে বাসনাতেই এসেছে এখানে ও।

তবে কিছুক্ষণ সময় নিচ্ছে সে। কোন তাড়া নেই তার। হাতে আছে অনন্ত সময়। কোন পিছুটান নেই। নেই কোন মায়ার বাঁধন। আজ তার সলিল সমাধির সংবাদটুকুও হয়ত কখনো পাবেনা কেউ। তবু শেষ কিছুটা সময় ওই দুটো মুখ ভাবতে বড় ভাল লাগছে ওর। হৃদয় মোচরানো এক ভাললাগা যা কেবল বুকে রক্তই ঝরায়, আর চোখে প্লাবন।

অবশেষে খানিকটা ধাতস্হ হয়ে দাঁড়ায় পান্না। সময় হয়ে গেছে। যা করার এখনই করতে হবে। সে মনস্হির করে অন্তিম প্রয়াণের জন্য প্রস্তুত হল।
লাফ দিতে যাবে এমনই সময়…………

পকেটের গহীন থেকে হঠাৎ বৃষ্টির শব্দে তার কান ভারি হয়ে উঠল। বৃষ্টির নিজের হাতে সেট করা রিংটোন। শুধুমাত্র ওর ফোন এলেই টোনটা বাজে। পান্না তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে কানে লাগায়-

ওপাশ থেকে- হ্যালো বাপি… বলে ওঠে মিষ্টি।
পান্নার মনে হয় সারা শরীরে বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে। রক্তের চাপ বেড়ে যায় শতগুন। সে কান্নাগলায় বলে ওঠে মা রে....
মিষ্টি তখন বলছে, বাপি আমি কাল আসছি।

পান্না নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনা।
অপরপ্রান্তে তখন বৃষ্টির গলা পাওয়া যায়, পারলাম না। তোমাকে ছাড়া আমি তো আমি তোমার মেয়েটাও থাকতে পারে না। বুঝি আমি যতটা না ভালবাসি তোমায় তার চেয়েও অনেক বেশি বাসে ও।

পান্না এখনও কাঁদছে।
এ কান্না দুঃখের নয়, পরাজয়ের নয়, গ্লানির নয়। সে হাত দিয়ে পকেট থেকে চিঠিটা বের করে আরেকবার। মোবাইলের আলোতে দেখে সেটা চিঠি নয়, অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। একই পকেটে থাকার কারণে অন্যমনস্কতায় ও চিঠিটাই ছিঁড়ে ফেলেছে।

থাক, ভালোই হয়েছে।
দুঃখের স্মৃতি না থাকাই ভালো।
পান্না একবুক আশা নিয়ে ভোরের অপেক্ষা করে। নুতন জীবনের নুতন ভোর।