লেখক-নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
১.
আকাশে মেঘ করছে.. এখানে বসে থাকাটা ঠিক হব কিনা বুঝে উঠতে পারছে না
কাঞ্চন.. প্রায় ৩-৪ ঘন্টা হতে চলছে, কিন্তু মানুষটার কোনো নাম গন্ধ নেই..
জায়গাটাকে আরো ভালো করে দেখে নিলো, ভুল জায়গায় চলে আসেনি তো সে? নাহ..
এই তো সেই জায়গা যেখানে গত ২৪ দিন ধরে প্রতিদিন নয়নের সাথে আসে সে, কখনো
নিজে আসে আর কখনো নয়ন বাসা থেকে পিক করে নিয়ে আসে.. বাচ্চা-কাচ্চা,
বুড়োবুড়ি, প্রেমিক-প্রেমিকা যারাই ছিল সবাই বৃষ্টির ডাকে পিছমোড়া করে
ভাগছে.. জোরে গর্জন হয়ে বাজ পরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল কয়েক
সেকেন্ড এর মধ্যেই.. কাঞ্চন এক পশলায় ভিজে গেল, আর ওঠার ইচ্ছা হলনা..
ব্যাপারটা কি বৃষ্টির ভালোলাগায়, নাকি মানুষটার প্রতি অভিমানে তা এই
মুহুর্তে বোঝাও যাচ্ছে না.. দুইদিন পরে কাঞ্চন এর ফ্লাইট, আর এইটাই হয়তবা
যাওয়ার আগে নয়নের সাথে শেষ দেখা হত.. নয়নকে দেওয়া কথা রাখতেই আজ
লাল-কালো জর্জেট শাড়ি, লাল চুরি, লাল টিপ আর কাজল দিয়ে সেজে এসেছে
কাঞ্চন, এইসব যে ওর খুব পছন্দের.. কিন্তু সব যে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেল..
যাক..২.
কাঞ্চন আর নয়নের দেখা হয় এই ঘটনার প্রায় ৪ বছর আগে.. গত তিন বছর আগে ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে.. আর তখন থেকে ওরা শুধু বন্ধুই.. যারা এই ব্যাপারটা মেনে নেয় তারা মানে, অনেকে এইটা জেনেও ব্যপারটা মানে না; আর যারা ওদের অতো ভালো চেনে না তাদের কাছে এইটা ভাববার কোনো কারণ নেই যে ওরা শুধু বন্ধু.. কিন্তু যারা ওদের সবচেয়ে কাছের মানুষ তারা এমন কিছু জানে যা নয়ন আর কাঞ্চন দুইজনের কেউই জানে না বা বুঝতে চায় না.. কিন্তু এইবার কাঞ্চনের বাইরে পড়তে যাওয়াটা ওদের দুইজনকেই দুবিধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে.. গত এক মাসে এমন একদিন যায়নি যে ওরা পার্কে দেখা করেনি.. কিছু ঘটার অপেক্ষা দুইজনেরই, কিন্তু কি ঘটবে? আদৌ কি ঘটবে?
৩.
পুরো সময়টা ছটফট করে কাটিয়েছে নয়ন, কিন্তু আজকে প্রজেক্ট এর কাজ না শেষ করলে স্যার উঠতে দিচ্ছিল না, এমনকি মোবাইলটা নিয়ে রেখে দিয়েছেন.. পুরো এক মাসের কাজ একদিনে শেষ করা কি যা তা কথা? ভুল কি নিজের নাকি কাঞ্চন এর? এই সময়টাই ও পেল বিদেশ পাড়ি দেয়ার জন্য.. কখনো যে এমন একটা দিন আসতে পারে ভাবতেও পারেনি নয়ন.. কিন্তু এইভাবে ওকে যেতে দিতে পারছে না সে, কিছু একটা বাকি রয়ে গেছে.. সেইটা কি… ধুর! ভেবে কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না.. কাঞ্চন নিশ্চই অনেক রেগে আছে.. আজকে যাওয়ার আগে শেষ দেখা হওয়ার কথা ছিল… প্রায় ৬ ঘন্টা আগে… নিশ্চই কাঞ্চন অপেক্ষা করে চলে গেছে এতক্ষণে.. বাইরে যেই ঝুম বৃষ্টি! ভাবতে ভাবতে স্যার এর রুম এর সামনে এসে পৌছল সে.. আতিফ ওর প্রজেক্ট জমা দিয়ে বের হয়ে আসছে.. নয়নও ঢুকে জমা দিয়ে বের হলো আর আতিফ কে সাথে নিয়ে বাসার পথে একটা রিক্সা ধরল.. মোবাইল চেক করলো, “29 Missed Calls”.. আতিফ এর জিজ্ঞাসু চোখ..
নয়ন: কিছু বলবি?
আতিফ: তুই কাঞ্চন কে জানাসনি যে আজকে যাবি না?
নয়ন: আমি নিজে কি জানতাম?
আতিফ: নিশ্চই এইটাও জানাসনি যে তুই চাসনা ও যাক?
নয়ন চুপ..
আতিফ: আর এইটাও না যে তুই ওকে কতটা চাস?
নয়ন: আমি ওকে এমন কিছুই বলব না.. অন্তত এখন না.. এখন ও ব্যাপারটাকে ঐভাবে উপলব্ধি করতে পারবে না..
আতিফ: তোর এইটা কেন মনে হচ্ছে?
নয়ন: কারণ ও নিজের বিদেশে যাওয়া নিয়ে ব্যস্ত.. আমি চাই না ওর ভবিষ্যতের পথে বাধা হতে..
আতিফ: Are you serious? তুই এইটাও দেখতে পাসনা, একটা মেয়ে যার কাল বাদে পরশু ফ্লাইট সে নিজের যাওয়ার জন্য ব্যস্ত না হয়ে গত একমাস ধরে প্রতিদিন তোর সাথে সময় কাটানোর জন্য ব্যস্ত.. তুই কি ওর মনের ব্যস্ততাটা সত্যি উপলব্ধি করতে পারছিস না? আমি কিছুই জানিনা নয়ন, তুই আজকেই ওকে সব খুলে বলবি… জরুরি না যে তোকে ভালোবাসলে ও থেকে যাবে, কিন্তু ও যখন ফিরবে শুধুমাত্র তোর জন্যই ফিরবে…
নয়ন: আমাদের দেখা করা সময় গত সাড়ে ছঘন্টা আগে চলে গেছে… আমি আজ ওকে শাড়ি পরে আসতে বলেছিলাম.. নিশ্চই খুব রেজে থাকবে আমার উপর.. কিন্তু আজকে দেখা হলেও ওকে আমি বলতাম না..
আতিফ: ঠিক আছে.. চল আমরা পার্ক হয়ে যাব, যদি কাঞ্চন ওখানে না থাকে তাহলে আমি এই ব্যাপার নিয়ে কোনো কথা বলব না.. আর যদি ও এখনো ওখানে থাকে, তুইই ঠিক করবি কি করতে হবে..
নয়ন: এই, রিক্সা ঘুরাও…
৪.
২০ মিনিট এর মধ্যে পার্ক এর গেইট এর সামনে..
আতিফ: আমি যা বুঝি তা বুঝতে তোর আরো ২০ বছর লেগে যাবে.. তুই ভিতরে যা.. আমি এই রিক্সা নিয়েই যাচ্ছি.. তোর বাসায় আন্টির হাতের ডিনার খেয়ে তবে বাসায় ফিরব.. টা টা!
আতিফ কে আটকানো গেলনা.. যাহ! এখন রিক্সা খুজতে হবে… ছাতা নিলেও অর্ধেক ভিজে গেছে সে.. ভিতরে গিয়েই বা কি লাভ.. খোলা খালি পার্ক, কেউ দেখে ফেললে ড্রাগখোর ভেবে বসবে.. একটাও রিক্সা দেখা যাচ্ছে না.. আতিফটাও পাগল… কিন্তু ওর কথা বিশ্বাস করতে মন চায়.. যদি সত্যি কাঞ্চনও তেমনি করে ভেবে থাকে.. যদি ভিতরে কাঞ্চন বসে থাকে.. কিন্তু তাতে তো কাঞ্চনের অসুস্থ হবার ভয় থাকে.. “এই রিক্সা দাড়াও”… কেমন যেন বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো.. “১ মিনিট দাড়াও, এখনি আসছি”..
দৌড়ে ভিতরে ঢুকে যা দেখল নয়নের দাড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে গেল.. ছাতা হাত থেকে পরে গিয়ে এক ঝলকে পুরোপুরি ভিজে গেল সে, আর ভিজে গেল মনটাও.. এতটা অবাক ও কখনই হয়নি.. কাঞ্চন বেঞ্চিতে বসে আছে.. থর থর করে কাপছে.. ঠোট কামড়ে ধরে আছে.. ও কাদছে.. বৃষ্টির পানির সাথে চোখের পানি মিশে একাকার হয়ে যাওয়া সত্তেও নয়ন বুঝলো ও কাদছে.. আস্তে আস্তে আতিফ এর বলা সব কথাগুলো নয়নের মাথায় সাফ হয়ে গেল… ছিঃ আতিফ যা বুঝলো, তা সে নিজে কেন কখনো বুঝলো না? কাঞ্চন এর জন্য ও নিজে যা করে আর কাঞ্চন ওর জন্য যা করে তার গভীরতা বুঝতে এতটা সময় লেগে গেল? আর বুকভরা আশা বহন করেই হয়তবা সে কাঞ্চন কে বিদায় দিত, কিন্তু কাঞ্চন যে বুকে পাথর বেধে যেত.. অনিশ্চয়তার আগুনে পুড়ে.. সারাজীবনের জন্য নয়নের হয়ে থাকার প্রত্যাশা কে মাটিচাপা দিয়ে.. নিজের হতে যাওয়া ভুলের কথা ভেবেই হয়তবা নয়নের ভিতরে নিঃশব্দ একটা কান্না ফুপরে কেদে উঠলো.. দ্রুত গিয়ে ও কাঞ্চনের হাতটা ধরে টেনে পার্কের বাইরে নিয়ে আসলো আর রিক্সায় চড়ে বসলো..
কাঞ্চন নিশ্চুপ.. একটিবার তাকায়নি পর্যন্ত নয়নের দিকে.. কান্নাও বন্ধ, শুধু নিচের দিকে চেয়ে আছে..
নয়ন: এইবার এমনিতে যেতে দিলে তুই নিশ্চই আমাকে মাফ করতি না? বল না কাঞ্চন? আর ফিরে আসতিনা?
কাঞ্চন রাগ আর প্রশ্ন ভরা ভেজা চোখে তাকালো নয়নের চোখে..
নয়ন: তুই বল, তুইও কি বুঝতে পেরেছিলি? আমি তো সব সময় একটু দেরিতেই বুঝি..
আলতো করে কাঞ্চন এর হাত দুটো নিজের হাতে নিলো সে.. কাঞ্চন এখনো সোজা নয়নের চোখে তাকিয়ে আছে..
নয়ন: পারবি না সারাজীবন আমার বুঝাশুনার timetable এর দায়িত্ব নিতে? কিন্তু প্রমিস কর এমন ভয়ঙ্করভাবে আর কখনো শিক্ষা দিবি না.. মানি ব্যাপারটা বড় রোমান্টিক.. কিন্তু আমি যদি এমন কিছু করি তাহলে তোর কেমন লাগবে?
কাঞ্চন এইবার নিচের দিকে তাকিয়ে ফুপরে কেদে উঠলো..
নয়ন কাঞ্চন এর গালে আলতো করে ধরে কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ” তোকে যে বড় ভালবাসি!”
কাঞ্চন কিচ্ছুটি না বলে নয়নকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলো.. এ যে অনেকদিনের জমানো আর্তনাদ…..