আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১২

"অতঃপর তাকে পাওয়া"

বৃষ্টি বেশ ভাল লাগত রিফাতের। একদম ঝমঝমানো বৃষ্টি না, আবার একদম ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও না। এ দুটোর ঠিক মাঝামাঝি বৃষ্টি হলে সবচেয়ে বেশি খুশি হত সে। তবে গত দু বছর ধরে বৃষ্টি হোক আর নাই হোক রিফাতের ভেতরে এক ঠাণ্ডা ঝড় বয়ে চলেছে অবিরত। বিয়ের পর থেকেই যেন কোন কিছুই ব্যাটে বলে হচ্ছে না। একা একাই নিউইর্কের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানসিক প্রশান্তির জন্য কিন্তু কিছুতেই যেন হিসেব মিলছে না। ভাল
বেসেই বিয়ে করেছিল আনিসাকে। যদিও আনিসার আগের নাম ছিল আনা। বিয়ের পর ধর্মান্তরিত হয় সে। তবে হতে পারে নি খাঁটি বাঙালি বউদের মত একজন যা রিফাতের তথা বাঙালি ছেলেদের আজন্ম এক সুপ্ত বাসনা। যার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবকিছুই কানাডা, আমেরিকা বা মেক্সিকোর মত পশ্চিমা দেশগুলোর নিজস্ব রীতি-নিয়মের বলয়ে আবদ্ধ তারই বা কি দোষ। একসময় মনে হত সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঐ মনে হওয়া পর্যন্তই। শেষমেশ যা হবার তাই হল। আলাদা ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, মনমানসিকতা, চাহিদার দুজন মানুষের মাঝে আর যাই হোক, সংসার করা সম্ভব না – দেরিতে হলেও এ উপলব্ধি তারা করতে পারে। এরপর আর কি! বিয়ের তিন বছর পর ডিভোর্স!

প্রথম ভালবাসার মানুষের সাথে সংসারের ইতি টানলেও স্মৃতিগুলো প্রতি নিয়ত অসহ্য রকমের যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছে রিফাতকে। এ অবস্থার মধ্যেও জীবিকার তাগিদেই নিউইয়র্কের এক দোকানে কর্মজীবন অব্যহত রাখল। আমি নায়লা। ইতিমধ্যে আমিসহ তার অন্যান্য কলিগরাও ব্যপারটা জেনে গেছে। খারাপ সময়ে ছেলের পাশে থাকার জন্য রিফাতের মা হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কে চলে এলেন দেশ থেকে। বাপহারা রিফাতের মা’ই যেন সবকিছু।

রিফাত প্রচণ্ড ঘাড় ত্যাড়া স্বভাবের। যাই বলবে সেটা যেভাবেই হোক করে ছাড়বে। এতটা জেদ দেখে আমি খুব অবাক হতাম। শুধু যে অবাক হতাম তা না, মাঝে মাঝে খুব বিরক্তও হতাম। একই জায়গায় কাজ করা লাগত বলে ঝগড়া হত প্রায় প্রতিদিনই। সব কিছুই ওর মত হওয়া লাগবে কেন! আমার কি মতামতের কোন দাম নেই! একবার খুব সাধারণ একটা বিষয় নিয়ে ওর সাথে তুমুল ঝগড়া হল। অবস্থা এতটাই খারাপ হল যে আমি চাকরি ছেড়ে দিলাম। বাসায় গিয়ে খুব কাঁদলাম। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করি, ‘আচ্ছা, ও এমন কেন?’ এরপর থেকে আমার মাঝে কি যেন একটা নেই নেই ভাব কাজ করত কিন্তু ধরতে পারতাম না। পরে বুঝতে পারি রিফাতের সাথে ঝগড়া করাটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে যেন প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজগুলোরই একটা। ফোনালাপ চলতে লাগল আস্তে আস্তে। যত দিন যাচ্ছে কথা বলার সময় ততই বাড়তে লাগল। অথচ কয়েক ঘণ্টা কথা বললেও যেন মনে হত কয়েক মিনিট কথা হয়েছে। অনেক রাত কেটে গেছে ফোনে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গিয়ে। কখনও কখনও ঘুম পাড়িয়ে দেয়া লাগত ওকে। মজার ব্যপার হল ফোনেও ঝগড়া চলত। প্রতিবারই ওর রাগের কাছে আমি হেরে যেতাম। প্রতিবারই আমাকেই ঠাণ্ডা করা লাগত রিফাতকে। কিন্তু আমিতো এরকম মেয়ে না। তবু কেন যেন ও সামনে থাকলে আমি আর আমি থাকতাম না। তাহলে কি আমি ওকে… যাহ! কি ভাবছি। আমার কি মাথা খারাপ যে এমন একগুয়ে টাইপের ছেলের সাথে সংসার করব। এ নিয়ে তেমন একটা ভাবতাম না যদি ওর কথা আমার মাঝে কোন আলোড়ন সৃষ্টি না করত। ওর কথাতে বুঝতে পারতাম ও আমার প্রতিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম ওর গলা টিপে ধরলেও আমাকে ও আগে প্রপোজ করবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।

বিয়ের বয়স হয়ে যাওয়াতে বাসা থেকে আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু হয় জানতে পারলাম। টেনশান গেল বেড়ে। আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম রিফাতকে আর অন্য কারও হতে দেব না। এও বুঝতে পারি ঘৃণা করার জন্য নির্দিষ্ট কারণ লাগলেও ভালবাসার জন্য কোন নির্দিষ্ট কারণ লাগে না। সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ‘তোমায় ভালবাসি’ কথাটা রিফাতকে জানিয়ে দিলাম। আনন্দ, চাপা টেনশান, মানসিক চাপ, আতংক সব মিলিয়ে যেন আমি অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যাই। রিফাত রাজি হবে জানা ছিল তবে আমার পরিবার কিছুতেই মেনে নিল না। খুব স্বাভাবিক কেনই বা মেনে নেবে? রিফাত তখন ভাল কোন পেশায় নিয়োজিত ছিল না। ওর ইনকাম দিয়ে কোনরকমে নিজের চলে যায় কিন্তু সংসার করার মত আর্থিক অবস্থা তখন নেই। তবে ছিল আমার প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা আর মায়া। সব পরিবারই চায় তাদের মেয়ে সুখী হোক। এজন্য অলরেডি স্ট্যাব্লিশ এমন ছেলে খোঁজা হচ্ছিল আমার জন্য। কিন্তু আমার সব সুখ যে রিফাতকে ঘিরে এটা কিছুতেই আমার বাবা-মা মেনে নিল না, কিছুতেই না। আমার পরিবারের একজনকেও পেলাম না আমার পক্ষে থাকতে এমনকি দুলাভাইরাও আমার ঘোর বিপক্ষে। অনেক চড়াই উতড়াইয়ের মধ্যে প্রবাসে আমি আমার গ্র্যাজুয়েশান শেষ করলাম।

আমরা মোট চার বোন, এবং আমিই সবার ছোট; ভাই নেই। সেজ বোনের বিয়ের কথা চলছে। আমি, মা, বড় দুবোন এই চারজন বাংলাদেশে রওনা দিলাম সেজ বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে এটেন্ড করার জন্য। তিন মাস পরেই রিটার্ণ টিকিট আমাদের। রিফাতের ধারণা ছিল দেশে গেলে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে পারে, এজন্য আমরা বিকল্প প্ল্যানিং করলাম। তবে তখনও বুঝিনি প্ল্যানগুলো এত কাজে আসবে। এও বুঝিনি আমার মত সাধারণ এক মেয়ের সামনে অপেক্ষা করছে দুঃসাহসিক কিছু অভিযান।
কলাবাগানের বাসায় ফিরেই বুঝতে পারলাম বাবা আমার উপর যথেষ্ট ক্ষ্যাপা। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যখন পাসপোর্ট আর ফোন কেড়ে নেয়া হল। আমি অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম। পায়ের নিচে যেন মাটি নেই আমার। রিফাতের সাথে যোগাযোগ করার একমাত্র উপায় বন্ধ হয়ে গেল আমার। সারা দিন রাত কাঁদলাম। কিন্তু বাসার সবার একই কথা- রিফাতকে ভুলে যাও। তোমার জন্য আরও ভাল ছেলে দেখা হচ্ছে, বিয়ে করে তবেই এখান থেকে যাবে। কথা ফাইনাল। আমিও চাইনি মা-বাবার অবাধ্য হতে। ছোট মেয়ে বলে আলাদা আদর যত্ন সবসময়ই পেয়েছি। কিন্তু রিফাতের চেহারা যখনই আমার মনের অতৃপ্ত আকাশে ভেসে ওঠে তখন আমি আর আমি থাকি না। এখন আসি আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর আর চ্যালেঞ্জিং দিনগুলোর প্রসঙ্গে।

তখন রোজার মাস। বাসায় একরকম বন্দি আমি। ঢাকা শহরের পথ ঘাট আমি কিছুই চিনি না। সেহরি খেয়ে সবাই ঘুমে। কেউ সকাল নয়টার আগে উঠবে না। হার্ট বিট বেড়ে যাচ্ছে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। মাকে চিরকুট লিখে সকালে বাসা থেকে পালিয়ে গেলাম দরজা খুলে। দোকান থেকে প্রথমেই ফোন দিলাম রিফাতকে, এরপর প্ল্যান অনুযায়ী রিফাতের দুই বড় ভাইকে ফোন দিলাম। উনারা আমার হবু ভাসুরের বাসায় নিয়ে গেলেন। সেখানেই হল আমার আশ্রয়। কিন্তু বিপত্তি হল আমার কাছে পাসপোর্ট নেই। দেশ থেকে পালাতে হবে এক সপ্তাহের মধ্যেই। কি যে উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাচ্ছে আমার বুঝাতে পারব না। ফোন দিলাম আমেরিকান এম্বেসিতে। ওদের জানালাম, আমি আমেরিকান সিটিজেন। এখানে জোর করে বিয়ে দিতে চাচ্ছে আমার পরিবার কিন্তু আমি রাজি নই। ইউএসএ তে যেন ফিরতে না পারি এজন্য আমার পাসপোর্ট এমনকি সেল ফোনও কেড়ে নিয়েছে। প্লিজ, হেল্প করুন। আমি বাসার ঠিকানা আর বড় দুলাভাই এর ফোন নাম্বার ওদের দিলাম যোগাযোগ করার জন্য। রুলস অনুযায়ী এখন আমেরিকান এম্বেসি আমাকে হেল্প করবে। এম্বেসী থেকে দুলাভাইকে ফোন দিয়ে বলা হল আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে এম্বেসিতে এসে পাসপোর্ট ফেরত না দিলে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব, প্রয়োজনে এরেস্ট করব। রাগে পরিবারের সবাই অগ্নিশর্মা আমার ওপর। কিন্তু তখন আমার আর করণীয়ই বা কি ছিল। দুলাভাই এসে পাসপোর্ট ফেরত দিল ঠিকই কিন্তু সারাদিন এম্বেসির চারপাশেই ঘুরঘুর করত আমাকে ধরার জন্য। আমি কয়েকদিন পর অবস্থা বুঝে পাসপোর্ট আনতে গেলাম এম্বেসি থেকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তবে এখনও অনেক কাজ বাকি। রিটার্ণ টিকিটের তারিখ আগাতে হবে নাহলে আমি যে কোন সময় কট খেয়ে যেতে পারি।

নির্ঘুম রাত যাচ্ছে আমার। বাইরে বের হলেই গা হাত পা কাঁপে। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। একদিকে মা-বাবার কান্না আরেক দিকে রিফাত। মা-বাবার আদর ভালবাসা আর রিফাতের ভালবাসা দুটোই দরকার আমার জন্য। আমি কোনটাই হারাতে চাই না। কিন্তু তখন এমন অবস্থা যে কোন একটা আমাকে বিসর্জন দিতে হবে। ইতিমধ্যে আমার হবু শ্বাশুড়ি আমাকে দেখে খুব পছন্দ করলেন। এমনকি উনার পরিবারের সকলের অপ্রত্যাশিত ওয়েলকাম পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত। রিফাতের বড় ভাই দুজন অনেক চেষ্টা করে আমার টিকিট ওকে করলেন তিনদিন পর। রিফাতের স্পর্শ পাওয়ার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। তবে এ কথা সত্য যে শ্বাশুড়ির সাপোর্ট না পেলে হয়ত আমার আর আগানো হত না। পরিবারের মায়া-মমতা, স্নেহ ত্যাগ করে ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে আমি চলে এলাম নিউইয়র্কে। রিফাতকে জড়িয়ে ধরে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম। তার অশ্রুসিক্ত কোমল আলিঙ্গনের উষ্ণতায় আমি আবার শক্তি ফিরে পেলাম নিজের মধ্যে। আর সময় নেই হাতে। হ্যা, আমরা বিয়ে করে ফেললাম।

এ খবর জানার পর থেকে আমার পরিবারে মুখ দেখানো বন্ধ, সাথে কথা বলাও। রিফাতকে হারানোর আর ভয় নেই এই বিশ্বাস আমার মনের মধ্যে ছিল, আছে, থাকবে। তবে কিছুতেই মা-বাবা মেনে নিলেন না। রিফাতের ইনকাম তেমন না থাকায় কষ্ট করেই দিন চলতে লাগল। যেদিন আমার ছেলে হল সেদিনই রিফাত খুব ভাল চাকরির কনফার্মেশান পেল। আমাদের তখন আনন্দের সীমা ছিল না। প্রচণ্ড আশাবাদী ছিলাম এবার অন্তত মা-বাবা ঠিক হবেন। কিন্তু না তখনও তারা অনড়। আমি আমার দিক দিয়ে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখলাম না। ভাল খারাপ মিলিয়ে দিন পার করতে থাকলাম আমরা। এক বছর পর আমাদের এক মেয়ে হল। দুই সন্তান এর মুখের দিকে তাকালে কোন দুঃখ কষ্টই যেন আর থাকেনা। ক্লান্তিও দূর হয়ে যায় এক নিমিষে। এরপর থেকে আমাদের আর পেছনে তাকাতে হয় নি।

এখন আমরা খুব হ্যাপি কাপল। বাবা-মার সাথে কথা হয় নিয়মিত। উনারা আলাদা স্টেটে থাকেন। সময় সুযোগ পেলে বাসায় এসে ঘুরে যান। আমাদের এখন বাড়ি আছে। আছে চমৎকার এক গাড়ি যেটাতে করে আমরা সবাই ঘুরতে যাই। বাসার পেছনের বাগানে বাচ্চা দুটো খেলে আর ‘মা’ ‘মা’ ডাক দিয়ে দৌড়ে এসে আমার কোলে ওঠে। এ ভাল লাগার কি কোন তুলনা হয়? এখনও মাঝে মাঝে মনে করি, পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়েটা কি আমি?

লিখেছেন-Rajeen Reasat (রাজিন রিয়াসাত)