আমাদের ফেসবুক পেজে জয়েন করুন http://www.facebook.com/vhalobashar.golpo

শুক্রবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১২

জীবনসঙ্গী

চারপাশে হৈ চৈ, বাড়ী ভর্তি মানুষ। সবার মাঝে চাঞ্চল্য, সব মিলে এক উৎসব মুখর পরিবেশ। হ্যাঁ, উৎসব ই তো। এ বাড়ীতে আজ বিয়ে। একটি ঘরে নানা বয়সী মেয়ে-মহিলাদের হট্টগোলের মাঝে বসে আছে “অবন্তি”। আজ অবন্তি-র বিয়ে। কিন্তু আর দশটা কনের মতো এসব কিছুই সে উপভোগ করছেনা। চারপাশের এই কোলাহল, উৎসব কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছেনা। খুব সুন্দর করে কনে সাজানো হলেও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যেন সে প্রাণহীন। স্থির দৃষ্টি, নেই কোন চাঞ্চল্যতা।
একটু আগেও সে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে, চোখ ফুলিয়েছে। কিন্তু এখন চাইলেও কাঁদতে পারছে না। এক মুহূর্তেই মন যেন তার পাথরের চাইতেও কঠিন হয়ে গিয়েছে। বুকের ভিতর তোলপাড় হচ্ছে, চেহারায় তা ফুটেও উঠছে কিন্তু চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও মনের কষ্টগুলো চোখ দিয়ে বের করতে পারছে না অবন্তি। কেন তার সাথে এমন হলো তার কোন হিসেব অবন্তি মেলাতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার শরীরে কেউ বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে, প্রচণ্ড ভারী এই শরীর নিয়ে সে টলছে। প্রচণ্ড অবসাদ ঘিরে ধরেছে। কি তার অপরাধ? কেন তার জীবনে এমন কঠিন সংকটময় সময়?

ইসহাক করিম ও সায়রা করিম--- অবন্তির বাব-মা। তিন বোনের মধ্যে অবন্তি দ্বিতীয়। দু’বছর আগে বড় বোনের বিয়ে হয়েছে তার পছন্দের ছেলের সাথে। যদিও বাবা-মার অসম্মতিতে নয়। বড় মেয়ে পাত্র নিজেই পছন্দ করায় ইসহাক সাহেবের প্রথমে যে একটু আপত্তি ছিল না তা নয়। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে পাত্র তারও অপছন্দ হয়নি। ধুমধাম করেই বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মেজ মেয়ে অবন্তি। স্নাতক চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। জীবন নিয়ে অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। জীবন কে খুব সুন্দর করে গড়তে চায়, নিজের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রুপ দিতে চায়। একমাত্র বিয়ের কথা ছাড়া বাবা-মার খুব বাধ্য মেয়ে অবন্তি। বাবা-মার অসম্মান হয় এমন কোন কাজ সে আজ পর্যন্ত করেনি। তার কাছে তার বাবা-মা ই সব। বাবা-মার একটু সুখের জন্য যে কোন চরম মূল্য দিতেও সে প্রস্তুত। আজকাল অবন্তির মতো এমন একটি মেয়ে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।
-----------------
খাটের মাঝে বসে আছে অবন্তি। ভেবেও কোন কূল-কিনারা পাচ্ছেনা তার দোষ আসলে কোথায়? বিনা দোষে কেন তার এই সাজা? অন্য আর পাঁচটা দিনের মতই আজকের দিনটা শুরু হয় অবন্তি-র। কোন কিছুতেই আলাদা কোন ছোঁয়া ছিল না। দুপুরে খাওয়ার সময় মা তাকে বলল বিকেলে একটু দাদাবাড়ী তে যেতে হবে। অবন্তির বাবা রা দুই ভাই, দুই বোন। চার ভাইবোন আলাদা আলাদা বাড়ীতে থাকলেও মাঝে মাঝে ছুটির দিনে কিংবা উৎসবে সবাই তাদের পৈতৃক বাড়ীতে মিলিত হন। তাই মা বলাতে আজকের দিনটিকেও অবন্তি তেমন কিছুই মনে করেছিল। বরং সে অনেক খুশি হয়েছিল।
কিন্তু অবন্তি যখন আজ এ বাড়ীতে এলো পরিবেশটা তার একটু অন্যরকম-ই লাগছিল। একটা উৎসবের আমেজ রয়েছে, কিন্তু কি উৎসব বুঝতে পারছিলনা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই তাকে ঘিরে ধরলো। যখন জানলো কেন এত সব আয়োজন অবন্তি তার বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আজ রাতে তার বিয়ে। কথাটা শোনার পর ওর মনে হয়েছে ও যেন এক অনুভবশূন্য মানবী। নিজের স্বপ্নগুলোকে ফানুসের মত উড়ে যেতে দেখছিল।
----------------
হঠাৎ ভাবনায় চির ধরলো অবন্তির। বাড়ীর সকলের মধ্যে চাঞ্চল্য বেড়ে গিয়েছে। কারণ, বরযাত্রী এসে পড়েছে। খবরটি শুনে অবন্তির রোমাঞ্চিত হওয়ার বদলে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আর একটু পরেই অবন্তির বিয়ে। সে জানে না কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে, কে হবে তার জীবনসঙ্গী। ‘জীবনসঙ্গী’... এই শব্দটি নিয়ে, স্বপ্নের পুরুষ কে নিয়ে কত স্বপ্নই না দেখেছিল অবন্তি। তবে কেন এই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা? বুকের মধ্যে কেন এই হাহাকার? তার সাথে এমন কেন হলো, কি তার দোষ? বাব-মার কাছ থেকে এর সদুত্তর অবন্তি পায়নি।
নাহ, বুকের মধ্যের এই হাহাকার অন্য কোন পুরুষের জন্য নয়। অবন্তির অভিযোগ জীবনসঙ্গী নিয়ে কিংবা বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করা নিয়েও নয়। অবন্তি-র অভিযোগ অন্য যায়গায়। তার কষ্ট তার বাবা-মা তাকে বুঝতে পারেনি। তার অভিযোগ এই পন্থায় তাকে বিয়ে দেয়া নিয়ে। বিকেলে তার বাব-মা তাকে যা বলেছে তার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, বড় মেয়ে নিজের পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করায় ইসহাক সাহেবের মনে হয়েছে হয়তঃ অবন্তিও এমন কিছু করতে পারে। কিন্তু অবন্তি কে বিয়ের কথা বললেই ও না করত। বাবা-মার কাছে কিছু সময় চাইত, বলত আগে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াই তারপর দেখা যাবে। বিয়ে নিয়ে অবন্তির এমন হেলাফেলায় তাদের সন্দেহ হওয়ায় তারা অবন্তিকে এভাবে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কথাগুলো শোনার পর অবন্তি সম্পূর্ণ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এই কি তবে ছিল কপালে? তার বাবা-মা তবে তাকে এতদিনে এই বুঝেছে!!! অবন্তি ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম। এই বয়স পর্যন্ত কখনও তার কোন বয়ফ্রেন্ড হয়নি। সে সবসময় ছেলেদের একটু এড়িয়েই চলেছে। কারণ একটাই, তার বাব-মা। এমন কোন কিছু সে করতে চায়নি যাতে তার বাবা-মা কষ্ট পায়। ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোন কাজ সে করেনি যাতে তার বাবা-মার অসম্মান হয়। বাব-মার সম্মানের কথা ভেবে জীবনে অনেক কিছুই সে ত্যাগ করেছে, জীবনটাকে উপভোগ করার অনেক সুযোগ থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত করেছে। আর আজ সেই বাবা-মাই তাকে একটুও বুঝতে পারলোনা......?
বরাবরই অবন্তির ইচ্ছা সে বাবা-মার পছন্দে বিয়ে করবে। কারণ সে জানে তার চাইতে তার বাবা-মা এই পৃথিবীটা কে অনেক বেশি দেখেছে। তাঁদের চাইতে ভালো, উপযুক্ত জীবনসঙ্গী অবন্তি নিজের জন্য বেছে নিতে পারবেনা। এই ইচ্ছেটা আরও প্রবল হয়েছে তার বড় বোনের বিয়ের পর। যেখানে সে জানে বাবা খুশি মনে বড় মেয়ের বিয়ে দিলেও একটা অতৃপ্তি তাঁর মনে রয়েই গিয়েছে। তাই অবন্তি চেয়েছিলো তার বাবা-মা কে তৃপ্ত করতে। কিন্তু তবুও তাকে আজকের এই দিনটি দেখতে হলো। দোষ তার একটিই, সে আরও কিছুদিন পরে বিয়ে করবে বলেছিল আর বাবা-মা বিয়ের কথা বললে আপাততঃ না করত। কিন্তু তার বাবা-মা সেটাকে ভুল বুঝে নিয়েছে। তাঁরা ভেবেছে হয় অবন্তি বিয়ে করতেই চায়না অথবা নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চায়। তাই তাঁদের মনে হয়েছে এটাই অবন্তিকে বিয়ে দেয়ার সবচেয়ে ভাল পন্থা।
------------------

এইমাত্র অবন্তির বিয়ে হয়ে গেল। সব কষ্ট সহ্য করে অনেকটা যন্ত্রের মতোই সে সম্পূর্ণ অচেনা একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কবুল বলল। কারণ সে তার বাবা-মা কে কথা দিয়েছে তাঁদের এতটুকুও সম্মানহানি সে করবে না। এভাবে বিয়ে দেয়ার কারণ জানার পর অবন্তি বিয়ে করতে রাজি হয়নি। সে বলেছিল তার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে, তাকে ভুল বোঝা হয়েছে। তার বাবা-মা তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, তাকে তাঁদের সম্মান রক্ষা করতে বলে। তাঁরা বলে তাঁদের হয়ত বুঝতে ভুল হয়েছে কিন্তু তাঁরা অবন্তির অমঙ্গল চায়না, তার কোন ক্ষতি তাঁরা করেনি। অবন্তি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল; বলেছিল, আমার সাথে বড় অন্যায় করলে তোমরা। আমি তোমাদের অবাধ্য ছিলাম না, শুধু নিজের জীবনের কিছু স্বপ্ন পূরণের সময় চেয়েছিলাম তোমাদের কাছে। তোমরা তাতেই ভুল বুঝলে। এই তোমাদের পছন্দেই বিয়ে করতাম আমি, কিন্তু তোমরা তা বুঝলে না। যেই মুহূর্তগুলো আমার জন্য হতে পারতো আনন্দময় তাতেই তোমরা আজ ভরে দিলে তিক্ততা। বাবা-মা কে নিয়ে করা আমার আজ পর্যন্তের সকল অহংকার কে তোমরা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলে। আমি তোমাদের সম্মান রক্ষা করবো, আমাকে যা বলবে তাই করবো। কিন্তু আমার সততার মূল্য তোমরা দিলে না। বাবা-মা কে কষ্ট দেয়ার আর পাঁচটা মেয়ের সারিতে তোমরা আমাকেও ফেললে। কোন মেয়ে যে তবে আর এতটা বিশ্বাস তার বাবা-মা কে করতে পারবে না। তোমাদের আমাকে জন্ম দেয়া, লালন-পালনের মূল্যই বুঝি আজ আমাকে দিতে হলো। কিন্তু তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার মূল্য আমি পেলাম না। বাবা-মার মুখে চুনকালি দেয়া আর পাঁচটা মেয়ের পরিণতিও আজ আমার হলো। অথচ এর একমাত্র কারণ তোমাদের সামান্য ভুল বুঝাবুঝি। তোমাদের মনের নিছক সন্দেহের মাশুল দিতে হচ্ছে আমাকে। আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের একটি দিন হয়ে গেল অভিশপ্ত......
------------------

ফুলে ফুলে সাজানো একটি খাটে বসে আছে অবন্তি। আজ ই ওকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হচ্ছেনা। আজ বিয়েটা হলো, কিছুদিন পরে অবন্তির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে ঘটা করে মেয়ে তুলে দেয়া হবে। তাই আজ এ বাড়ীতেই ওর ফুলশয্যা। পৃথিবীর আর সব মেয়েদের মতো ফুলশয্যা নিয়ে অবন্তির ও ছিল কতনা স্বপ্ন, কত কৌতূহল। কিন্তু স্বপ্নের সেই রাতটি তার জীবনে পেয়েও সে অনুভুতিশূন্য। এখন পর্যন্ত সে জানেনা কার সাথে সে এই পুরোটা জীবন পার করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। অবন্তি তার দাদি-নানি দের কাছে এমন গল্প শুনেছে যে, তাঁদের সময়ে এমনভাবে বিয়ে হতো। কেউ কাউকে দেখত না জানত না, একেবারে ফুলশয্যার রাতে দেখা হতো। শুনে শুনে অবন্তি ভাবতো যে সে বেঁচেছে ঐ সময়ে তার জন্ম হয়নি। কিন্তু, অবন্তি কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি যে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া উন্নত বিশ্বের এই সময়ে জন্মেও অবন্তির ভাগ্যে সেই আদিম রীতিই লেখা ছিল।
হঠাৎ ই দরজার শব্দে অবন্তি সচকিত হল। তার বোন-ভাবিরা একজনকে তার ঘরে নিয়ে এলো। তাদের কোন খুনসুটি, হাসিঠাট্টাই অবন্তি কে স্পর্শ করলো না। অবন্তি নিশ্চুপ।
অচেনা অজানা সেই মানুষটি এখন তার পাশে বসা। ঘরে পিনপতন নিরবতা। অবন্তি বুঝতে পারছে না সে কি করবে, কি বলবে। কি ই বা বলার আছে তার? ইচ্ছে করছে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় চলে যেতে। তার মনে হচ্ছে সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এই মুহূর্তে তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো পাশে বসা মানুষটির উপর। সে নিজে না হয় একটি ভুল বুঝাবুঝির শিকার, কিন্তু এই মানুষটির কি সমস্যা? সে কিভাবে না দেখেই একটি মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হলো? সে চাইলে তো অবন্তি কে আজ অন্তত এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।

পাশ থেকে গলা পরিষ্কার করার শব্দ এলো।
- অবন্তি, তুমি কি একটু আপসেট?
- (অবন্তি নিশ্চুপ)
- কিছু বলবে না?
- (অবন্তি এবারও নিশ্চুপ, তার চোখ দু’টো দেয়াল ঘড়িতে স্থির)
- তোমার মনে অনেক কষ্ট জমে আছে, তাই না? শেয়ার করবে আমার সাথে?
- এবার অবন্তি একটু যেন ঝাঁঝিয়ে উঠলো..... আমি না হয় জানতাম না কিন্তু আপনার ব্যাপারটা নিশ্চয়ই আমার মতো নয়? আপনি তো নিশ্চয়ই জানতেন। তো আপনি কিভাবে একজন অজানা অদেখা মেয়েকে এভাবে বিয়ে করতে রাজী হলেন?
- বিশ্বাস করো, তুমি যেভাবে ভাবছো আসলে তেমন কিছুই না। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে তুমি আমার অজানা কিন্তু অদেখা এটা ঠিক সত্যি হলনা। দেখো, বিয়ের ব্যাপারে আমি আমার বাবা-মার উপর ই নির্ভরশীল ছিলাম। সেক্ষেত্রে তোমাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্তই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর তোমাকে দেখার কথা বলছ? আমার মা তোমাকে কোথাও দেখেছিল। আর আমার দেখা বলতে তোমার একটি ছবি। মার তোমাকে পছন্দ হওয়ার পরে আমাকে তোমার একটি ছবি দেখায়। এখন তোমার ছবি দেখামাত্র তোমাকে ভাল লাগলে আমার কি দোষ বলো?
- (অবন্তি-র চোয়াল শক্ত হল)
- ন্যাকামি করছি না। সত্যি বলছি। তোমার ছবিটি আমি খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। সবচেয়ে ভালো লেগেছে তোমার চোখ। কারণ সেখানে আমি দেখেছি অন্যরকম এক সরলতা, যা ঠিক ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। আমার মনে হয়েছে এই চোখ স্বপ্ন বুনতে জানে, এর আছে সম্পূর্ণ আলাদা এক স্বপ্নজগত। এই চোখ জানে কি করে স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। ঐ চোখের স্বপ্নগুলোকে নিজের করে নিতে বড্ড ইচ্ছে হলো। তাই কোন আনুষ্ঠানিক কনে দেখার প্রয়োজন আমি অনুভব করিনি।
- বাহ, আপনার তো তবে ষোল আনাই পূর্ণ...... কিন্তু আমার ???
- আমি মানছি হয়তো তোমার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। এ ঘরে আসার আগে ভাবী আমাকে কিছু কথা বলেছে। যতটুকু জানলাম তোমার সাথে হঠাৎ করেই সব হয়েছে, যার জন্য তুমি হয়ত প্রস্তুত ছিলে না। কিন্তু তোমার সাথে কেন এমন করা হলো তার উত্তর তো আমার কাছে নেই অবন্তি।
- আমার প্রশ্নের উত্তর কারও কাছেই নেই।
- তোমার যখন মনেই হয় যে কারও কাছেই তোমার কোন প্রশ্নের উত্তর নেই, তবে শুধুশুধু এসব ভেবে কেন আমাদের এই মধুর রাতটি নষ্ট করছ বলতো?
- মধুর রাত! মধুর রাতের মধু চাই আপনার তাইতো? দেখুন সম্পূর্ণ সজ্ঞানে যখন আপনাকে স্বামী হিসেবে কবুল বলেছি তখন এই সম্পর্ক তো আর অস্বীকার করতে পারিনা। তাই যেমন আপনি আমার স্বামী, তেমনি কিছু অধিকারও আপনার আছে। আমার উপর আপনার স্বামীর অধিকার আদায়ে কোন বাঁধা আমি দিবনা, তাই স্বামী হিসেবে আপনার অধিকার আপনি আদায় করে নিতেই পারেন। তাতে যদি আপনার মধুর রাতটি মধুময় হয়......... (যন্ত্রের মতো কথাগুলো বলে গেল অবন্তি)।
- অবন্তি !!! আমি জানিনা তুমি কি ভাবছো আমাকে, আমার কথার মানে এমনটা ছিলনা। তুমি নিজে থেকেই এসব ভাবছো। আমার মনের এমন কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আমি তোমাকে কথাটা বলিনি। তোমার মন খুব অশান্ত আছে, তাই এসব ভাবনা আসছে তোমার মনে।
- (অবন্তি নিশ্চুপ)
- তোমার সমস্যাটা কোথায় আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে কিছু না বললে কি করে জানবো?
- (অবন্তি তবুও চুপ)
- আশ্চর্য !!!! আর কত এভাবে চুপ করে থাকবে, আমি জানতে চাই তোমার সমস্যা কোথায় ??? (কথাটা একটু চেঁচিয়েই বলল)
সেই সন্ধ্যা থেকে হাজার চেষ্টা করেও যা অবন্তি পারছিল না সেই কান্না-ই এবার চোখের বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো।
- I’m so sorry. আমার এভাবে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠা উচিত হয়নি। আসলে আমি কিছু বুঝতে পারছিনা যে কি হয়েছে? I’m really sorry.
- অবন্তি ডুকরে ডুকরে কাঁদছে।
- অবন্তি, প্লিজ এভাবে কেঁদোনা। তোমার সব কথা আমাকে বলো, আমি শুনতে চাই। আমাদের কি তবে কোনও ভুল হলো? তুমি কি তবে অন্য কাউকে......... ?
- আপনি যা ভাবছেন তার কিছুই না, কাঁদতে কাঁদতেই বললো অবন্তি।
- তাইতো বলছি আমাকে সব কথা খুলে বলো, যেন কোনরকম ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি না হয়। কান্না থামাও, বলো আমাকে কি হয়েছে?
- অবন্তি নিজেকে একটু সামলে নিল তারপর একে একে সব কিছু বলতে শুরু করলো,
এই মুহূর্তে সব কথা গুছিয়ে বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিয়েটা আমাকে জোর করে দেয়া হয়েছে ঠিক ই কিন্তু বিয়েতে আমার অমতের কারণ অন্য কোন পুরুষ নয়। আমার কষ্ট অন্য যায়গায়। আমার বাব-মা আমাকে বিয়ের কথা বললে আমি একটু এড়িয়ে যেতাম। কারণ আমার ইচ্ছে ছিল আগে পড়াশোনা শেষ করবো, তারপর নিজের স্বপ্নগুলো পূরণ করবো। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন। তাই এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে স্বপ্ন পূরণের পথে কোন বাঁধা চাইনি। বিয়ে নিয়ে আমার এই এড়িয়ে যাওয়াকে বাবা-মা ভুল বুঝেছে। তারা ভেবেছে হয় আমি বিয়েই করতে চাইনা, নয়ত আমার পছন্দের কেউ আছে। আমার বড় বোন নিজের পছন্দে বিয়ে করায় আমার প্রতিও তাঁদের এমন সন্দেহ এসে যায়। কিন্তু আসলে এমন কিছুই না।
আপনাকে যে কথাগুলো বললাম এগুলোই সত্য। ছোটবেলা থেকেই আমি বাবা-মার খুব বাধ্য। তাঁদের কোন কথায় কখনও দ্বিমত করিনি, তাঁরা কষ্ট পাবে এমন কোন কাজ করিনি। বিয়েটাও বাবা-মার পছন্দে করার ইচ্ছাই ছিল। কিন্তু আমার কষ্ট ওরা আমাকে ভুল বুঝলো, এত কিছু করেও তাঁদের বিশ্বাস আমি অর্জন করতে পারিনি। তাঁরা আমার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টাও করেনি। আমার স্বপ্নগুলোকে ভেঙ্গে দিল। এই বিয়েটা স্বাচ্ছন্দে করতে আমার কোন দ্বিধা থাকতো না। কিন্তু আমাকে এভাবে ভুল বুঝা, হঠাৎ সবকিছু ঘটে যাওয়া আমি মানতে পারছিনা।
একটু থেমে.........
দেখুন, জানিনা আমার কথাগুলো আপনার বিশ্বাস হচ্ছে কি না। কিন্তু আমি যা বললাম ঘটনা আসলে এটাই। আমি যা কষ্ট পাওয়ার পেয়েছি, আমার ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে। কিন্তু আমি আপনার জীবনটা নষ্ট করবো না। জীবনের আকস্মিক এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে আমার শুধু একটু সময় দরকার।
- হুমম...... তোমার সাথে সত্যিই অন্যায় হয়েছে। কিন্তু স্বস্তি পেলাম এই জেনে যে কোন ভুল হয়নি।

-----------------

ঘরে প্রচণ্ড নিস্তব্ধতা। অবন্তির চোখ দেয়াল ঘড়িতে স্থির। এই ঘরে শুধুমাত্র ঐ ঘড়িটাতেই প্রাণ আছে বলে মনে হচ্ছে। টিক...টিক...টিক...
হঠাৎ অবন্তি তার হাতে অন্য একটি হাতের স্পর্শে চমকে উঠলো!
- অবন্তি, জানিনা আমাকে তুমি কতটুকু বুঝবে। সব মেয়ের ই নিশ্চয়ই একজন স্বপ্নপুরুষ থাকে, তোমার সেই স্বপ্নে দেখা মানুষটির সাথে আমার কতটুকু মিল আছে আমি জানিনা। কিন্তু একজন বন্ধু হিসেবে আমি মন্দ হবো না। আজ থেকে আমাকে তুমি তোমার একজন বন্ধু ভাবতে পারো। আর এই যে তোমার হাতটি ধরেছি, ছেড়ে দেবার জন্য নয়। কখনও ভাববে না যে তোমার দেখা স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে গিয়েছে। আমার এই হাতটি ধরেই তুমি এগিয়ে যাবে তোমার স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে। আগেই বলেছি ঐ দু’চোখের স্বপ্নগুলোকে নিজের করে নিতে ইচ্ছে হয়েছে। তাই আজ থেকে তোমার স্বপ্নগুলো আমারও। তুমি একা নও, দু’জনে মিলে স্বপ্নগুলোকে বাস্তব রূপ দিব।
অবন্তি আবার কাঁদতে শুরু করলো।
- না, একদম কাঁদবে না। তোমাকে প্রথম দেখার পরই তোমাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন সাজিয়েছি। ভালোবাসার মানুষের চোখের পানি সহ্য করা যে কতটা কষ্টের তা হয়তো তুমি জানো না।
অবন্তি, তোমার জীবনসঙ্গী নিয়ে কত স্বপ্ন তুমি দেখেছো আমার জানা নেই। আমার সাথে তার কতটুকু মিল পাবে তাও জানিনা। তুমি নিজেও কিন্তু তা জানার চেষ্টা একটি বারের জন্যও করনি।
- মানে? অবন্তি অবাক হয়ে তাকাল
- যাক, মানেটা আমাকে আর বলে দিতে হল না।
- অবন্তি কিছু না বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল
- এই এতক্ষণ আমরা পাশাপাশি বসে আছি, কিন্তু একটিবারের জন্যও তুমি আমার দিকে ফিরে তাকাওনি। স্থির দৃষ্টিতে ঐ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থেকেছ, কিন্তু আমি কে, দেখতে কেমন এসব জানার কোন চেষ্টাই তুমি করোনি।
- অবন্তি কথাটা বুঝতে পেরে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল
- হা...হা... এই যাহ, কিছু না বললেই মনে হয় ভাল ছিল। যাক অন্তত আমার দিকে তাকালে তো। এখন যতই চোখ নামিয়ে নাও না কেন শুভদৃষ্টি টা কিন্তু হয়েই গেল। ছবিতে তো ঐ চোখে কত তাকিয়ে থেকেছি, কিন্তু এত কাছে থেকেও স্বপ্নভরা চোখ দুটো দেখার সুযোগ ই ঠিকমত পেলাম না। ঠিক আছে, ঐ চোখে হারিয়ে যেতে না হয় আরও কিছুদিন অপেক্ষা করবো।
অবন্তি আজ থেকে তুমি আমাকে তোমার খুব ভাল একজন বন্ধু ভাবতে পারো। তোমার জীবনের সব আনন্দ-দুঃখ তুমি আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। তুমি এগিয়ে যাও, আমি তোমার সাথে আছি। নিজেকে মানিয়ে নিতে যত সময় তোমার প্রয়োজন, তুমি পাবে। আমি সকালেই চলে যাব। আর আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যতদিন পর্যন্ত তুমি নিজ থেকে আমাকে ভালবাসতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত স্বামীর অধিকার আদায়ের কোন চেষ্টা আমি করবো না।
- অবন্তি একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে
- মনটা একটু হালকা লাগছে? দেখো, সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে।
রাত তো শেষ হয়ে এলো। অনেক কথাই হলো কিন্তু আমার সম্পর্কে তুমি কিছুই জানলে না। এমনকি, মনে হয় তুমি আমার নামটাও জানো না। যদিও অনেক সময় আছে জানার বোঝার, তবুও টুকটাক কিছু তো এখন ই বলা যায়। আমি অর্ক। অর্ক রায়হান... ... ...

বাকি সময়টা এভাবেই কথা বলে কেটে গেল। সকালে অর্ক চলে গেলে দুপুরের মধ্যেই অবন্তিরা নিজেদের বাড়ীতে ফিরে গেল।
------------------------

অর্ক রোজ ফোন দেয়। তাদের অনেক কথা হয়। দুজন দুজন কে জানছে বুঝছে। কিছুদিনের মধ্যেই অবন্তি একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলো। অর্ক সবসময় একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে ফোন দেয়। ঘণ্টার ৩০মিনিট এবং ৪৫ মিনিট যে কোন একটি সময়ে। যেমন- ৫:৩০ বা ৭:৪৫, ৮:৩০ বা ১০:৪৫। এই দুটো সময়ের পিছনে একটা কারণ আছে, যা অবন্তি ধরতে পারলো। প্রথম সময়টি ছিল যখন অর্ক প্রথম অবন্তির হাত ধরেছিল, আর দ্বিতীয়টি যখন অবন্তি প্রথম অর্ক-র দিকে তাকিয়েছিল। সেই রাতে অবন্তি অনেকটা সময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকায় মুহূর্তগুলো ওর চোখে পড়েছিলো। কিন্তু অবন্তি কখনও ভাবতেও পারেনি যে অর্কও ঐ সময়গুলো লক্ষ্য করেছে এবং প্রতিটা সময়ে ঐ মুহূর্তগুলো মনে করে চলেছে। এই প্রথম অবন্তির মনে অর্ক-র প্রতি প্রচণ্ড এক ভালোলাগা ছুঁয়ে গেল। অবন্তি যখন অর্ক কে ব্যাপারটা বলল অর্ক খুব অবাক হয়েছে অবন্তি কিভাবে বুঝলো ভেবে..... তারপর খুব হাসল। অবন্তি এই প্রথম অর্ক-র এমন প্রাণখোলা হাসি শুনল। খুব ভাল লাগলো ওর।
অবন্তি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে তার স্বপ্নের পুরুষটি অনেকাংশে অর্ক-ই। ও যথেষ্ট কেয়ারিং তাতে কোন সংশয় নেই, এছাড়াও আছে আরও অনেক মিল। অবন্তির মতো অর্কও চাঁদ, জ্যোৎস্না রাত, বৃষ্টি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসে। মাঝে মাঝে অর্ক-র কিছু পাগলামি তে মজা পায় অবন্তি। তার মতে যেহেতু তাদের বিয়েটা হয়েছে একটু পুরনো রীতিতে তাই সে পুরনো রীতি মেনে অবন্তি কে চিঠি লিখবে। অবন্তি-র অনেক অনুরোধে বাই পোস্ট না পাঠিয়ে সে ই-মেইল করে। কিন্তু ই-মেইল হয় পুরো চিঠির আদলেই। রোজ ফোনে কথা হওয়ার পরেও চিঠির আকার এত বড় কিভাবে হয় তা অবন্তি ভেবে পায়না। সেইসব চিঠির উত্তরে অবন্তি চিঠির আকারের অর্ধেকেরও কমই লিখতে পারে।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। অবন্তি ধীরে ধীরে কিছুটা সহজ হয়ে উঠছে, একসময় অর্ক কে অবন্তির সত্যিই ভাল লাগতে শুরু করলো। প্রায় ছ’মাস পরে ঘটা করে অবন্তি অর্ক-র ঘরে গেল। অবন্তি অনেকটা সহজ হয়ে এলেও ওর মাঝে এখনও রয়েছে অনেক জড়তা।
-----------------------

কয়েকদিন পর... ... ...

আজ খুব সুন্দর জ্যোৎস্না রাত, আকাশে কি সুন্দর চাঁদ। জানালায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে দেখতে অবন্তি অনেক ভাবলো। অর্ক তার কথা রেখেছে, সে একজন বন্ধু হিসেবে অনেক সাপোর্ট করেছে তাকে। সে নিজেও এখন সব মানিয়ে নিতে পারছে। এসব কিছুই অর্ক-র সাহায্য ছাড়া সম্ভব হতো না। অর্ক তার দায়িত্ব পালন করেছে, এবার অবন্তির পালা। অর্ক-র জীবনটা সুন্দর করে সাজানো এবার ওর দায়িত্ব। ওদের জীবনটা খুব সুন্দর করে সাজাবে অবন্তি।

অর্ক কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অবন্তি জানেনা। তাই ওর কথাতে চমকে ওঠে...
- আজ চাঁদ টা কি সুন্দর দেখেছো অবন্তি?
- হুমম...
- কি ভাবছিলে?
- কিছু না।
- কি দেখছ এভাবে?
- তোমাকে।
- আমাকে দেখার কি আছে?
- অনেক কিছু। Thanks a lot… যদিও এই Thanks তোমার সামনে অনেএএক ছোট। আমি সত্যিই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ.
- Thanks for what?
- For everything you have done for me.

বেশ কিছুটা সময় তারা একে অন্যের চোখে তাকিয়ে থাকে। এ দৃষ্টি যেন অপলক... ...
অবন্তি ফিসফিসিয়ে বলে—
- Will you be mine?
- I’m always yours… … But from this moment you are mine…. বলে অর্ক অবন্তিকে জড়িয়ে ধরলো।

অবন্তির মনে হয় এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব সুখ শুধুই ওর। পৃথিবীর আর কারও প্রতিই ওর কোন রাগ বা অভিমান নেই। বরং সবার কাছে ও কৃতজ্ঞ।
ওরা দুজন দুজনের ভালোবাসার মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলো। বাতাসে ভেসে এলো গানের সুর---

“এ লগনে তুমি আমি একই সুরে মিশে যেতে চাই,
প্রাণে প্রাণে সুর খুঁজে পাই...
এ তিথি শুধু গো যেন তোমায় পাওয়ার,
এ শুধু গানের দিন এ লগনও গান শোনাবার... ।।“

লিখেছেন-ভোরের পাখি