ঘুম
ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসে ইফতি। আজ যে তাকে অনেক দূর যেতে হবে। অ-নে-ক
দূর ! ৫টা বেজে গেছে। নাহ, আর দেরি করলে চলবে না। উঠে পড়ে দ্রুত হাতে সব
কিছু গুছিয়ে নিতে থাকে সে। সব কিছু শেষবারের মতো চেক করে দরজাতে তালা
দিয়েই এক ছুটে রাস্তায়। যত দ্রুস্ত সম্ভব বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতে হবে।
ভাগ্য ভালো এই সাতসকালে একটা খালি সিএনজি পাওয়া গেলো। তবুও সিলেট
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনে টিকেট কেটে উঠে বসতে বসতে
ততোক্ষণে ঘড়িতে প্রায় ৭ টা। ১৫ মিনিট পরেই ছেড়ে দিলো বাস। আবারও একবার
ঘড়ি দেখে নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ইফতি। আজ অনেক বড় একটা
রিস্ক নিতে যাচ্ছে সে। অবশ্য এমন রিস্ক যে আগে কখনও নেয়নি তা নয়, তবে
আজকের কথা সম্পূর্ণ আলাদা এবং স্পেশালও বটে।
কাল ১০ জুলাই- দীপার
জন্মদিন। এর আগের বছরগুলোতে দীপা বাসায় থাকতো বিধায় ইচ্ছে থাকলেও ইফতি ওর
জন্মদিনে কোনও উপহার দিতে পারেনি । এই প্রথম সুযোগ পাচ্ছে ইফতি। তাই অনেক
দিন আগে থেকেই ভাবছিল কী উপহার দেওয়া যায়। কিন্তু কোনও কিছুই মন মতো
হচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলো ও নিজেই হবে ওর প্রিয়তমার জন্মদিনের
উপহার। যেই ভাবা সেই কাজ। দীপাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে কাউকে কিছু না বলে
রাজশাহী রওনা হয়েছে ইফতি। রাতের বাসে সরাসরি যাওয়া যেতো, তাতে কষ্টও কম
হতো। কিন্তু রাতের বেলা অবধারিতভাবেই দীপা ফোন দেবে। সহজেই বুঝে ফেলবে যে
ইফতি বাসে। এই ভয়ে ইফতি ঠিক করেছে সিলেট থেকে সকালে রওনা দিয়ে দুপুরের
মধ্যে ঢাকা , ওখান থেকে আবার রাজশাহীর বাস ধরে রাতের মধ্যে রাজশাহী পৌঁছবে।
হোটেলে গিয়ে উঠবে,তারপর সকালে দীপার কাছে গিয়ে ওকে চমকে দেবে। মাত্র দিন
১৫ আগেই রাজশাহী থেকে ঘুরে এসেছে ও। কিন্তু নিজের জন্মদিনে অপ্রত্যাশিত
ভাবে ওকে দেখার পর দীপা কতোটা খুশি হবে সেকথা ভাবতেই আনন্দে বুকটা ভরে
যাচ্ছে ইফতির।
ফোন বাজছে। এই রে ! দীপা ফোন করেছে। কী উত্তর দেবে
ইফতি? ইফতির আবার একটা সমস্যা হচ্ছে গিয়ে সে সবার সামনে অবলীলায় মিথ্যা
বলতে পারলেও দীপার সামনে মিথ্যা বলতে গেলে সব গুলিয়ে ফেলে। ইফতির তোতলামি
শুনে দীপাও সহজেই ধরে ফেলে। একারনেই ইফতি দীপাকে কখনও মিথ্যা বলতে পারেও
না,বলেও না। কিন্তু এখন কী করা যায়? ভয়ে ভয়ে ফোন ধরল ইফতি।
* “কোথায় তুমি ?”
* “আমি? ইয়ে...আমি তো বাসে।”
* “বাসে?! কোথায় যাচ্ছ?”
* “ইয়ে মানে ঐ যে আমার একটা ফিল্ড-ওয়ার্ক এর কথা ছিলো না, হবিগঞ্জে ?
ওখানেই যাচ্ছি। ফিরতে মনে হয় রাত হবে। আর জানোই তো ওখানে মোবাইল এর
নেটওয়ার্ক নেই । তাই ফোন বন্ধ পেলে টেনশন করো না কেমন? নিজের দিকে খেয়াল
রেখো, আমি ফিরে এসে ফোন দেবো।”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে ফোন রাখল ইফতি। উফফ... রাজশাহী যাওয়া পর্যন্ত সারপ্রাইজ ধরে রাখতে পারলে হয় !
অনেক জ্যাম পেরিয়ে ইফতি যখন ঢাকা পৌঁছল তখন বেলা ২টা বেজে গেছে। একটুও
দেরি করা যাবে না। ওদিকে রাজশাহী পৌঁছতে দেরি হলে তখন আবার হোটেল পাওয়া
যাবে না। রাতে থাকবে কোথায় তখন ? পড়িমরি করে গাবতলী ছোটে ইফতি। ৪টার বাস
ধরে রাজশাহী রওনা হয়ে যাওয়ার পর খেয়াল হল তাড়াহুড়ার মধ্যে সারাদিন
কিছু পেটে পড়েনি। থাক, কী আর করা ? সময় মতো যেতে পারলে খাওয়ার অনেক
সুযোগ পাওয়া যাবে।
এরই মধ্যে দীপা অনেকবার ফোন করেছে। প্রথম
ক’বার ধরেনি, দুপুরের পর থেকে মোবাইলই বন্ধ করে রেখেছে ইফতি। মিথ্যা বলতে
খারাপ লাগছে, কিন্তু সারপ্রাইজ দিতে এতোটুকু মিথ্যে বলতেই হবে। তবুও মন
খারাপ লাগে ইফতির।
পথ যেন শেষ হতেই চায় না। আবারও অনেক বিরক্তিকর
জ্যাম পেরিয়ে রাজশাহী পৌঁছাতে রাত ১০ টা বেজে যায় । সারাদিনের ক্লান্তি
যেন এক মুহূর্তেই কোথায় উবে যায় ! হ্যাঁ, সে পেরেছে । এতোখানি কষ্ট
সম্ভবত সার্থক হতে চলেছে। হোটেলে রুম নিয়ে ফ্রেশ না হয়েই দীপাকে ফোন দেয়
ইফতি।
-“তুমি কোথায় ছিলে এতক্ষণ ?” রাগ ঝরে পড়ে দীপার গলায়।
-“আর বোলো না, হবিগঞ্জ থেকে ফিরে ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের রুমে
গিয়েছিলাম , তাই ফিরতে রাত হল।” শুকনো গলায় আবারও মিথ্যে বলা। কিন্তু এ
ছাড়া যে উপায় নেই!
অনেকক্ষণ লাগে দীপাকে ঠাণ্ডা করতে।
ঘুণাক্ষরেও দীপাকে বুঝতে দেয় না ইফতি যে সে রাজশাহীতেই। একাকী হোটেল রুমে
শুয়ে শুয়ে রাত ১২টা বাজার অপেক্ষা। ১২ টা বাজতেই দীপাকে ফোন।
-“শুভ জন্মদিন, সোনামণি !”
ততক্ষণে দীপার বান্ধবীরাও ওর রুমে এসে হই-চই শুরু করে দিয়েছে। স্মিত হেসে
ফোনটা রাখে ইফতি। কিছুক্ষণ পর দীপার ফোন এলো। সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমে
চোখ ভেঙ্গে আসতে চায়। তবুও দীপাকে এতোটুকু বুঝতে না দিয়ে অনেক রাত অবধি
কথা বলে ইফতি।
সকাল ৬ টায় ঘুম ভেঙ্গে বাইরে তাকাতেই মনটা দমে
যায়। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ইশ, বৃষ্টি নামার আর সময় পেলো না! তাতে কী
হয়েছে ? দীপার জন্মদিন যে আজ! ঝড়-তুফান হলেও বসে থাকলে চলবে না। হোটেল
থেকে চেক-আউট করে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই রাস্তায় নেমে পড়ে সে।
বৃষ্টি-স্নাত সকালের অলস শহর। রিকশা পেতে পেতে পুরোপুরিই ভিজে গেলো ইফতি।
ইফতি যতবার দীপার সাথে দেখা করতে যায়, সবসময় ফুল নিতে ভোলে না। সাত সকালে
কোনও ফুলের দোকানও খোলেনি। আজ ওর জন্মদিনে যাবে, অথচ ফুল ছাড়া ? থাক, কী
আর করা যাবে, আগে তো দীপার সাথে দেখা হোক।
হোস্টেলের সামনে এসে দীপাকে ফোন দেয় ইফতি।
* “এই শোন, তোমার জন্য একটা গিফট পাঠিয়েছি, একটু নামবে ?”
* “এই সাত সকালে গিফট?! কার কাছে? কীভাবে?”
* “আহা, নামো না একটু...।”
এই ঝুম বৃষ্টিতে, তাও আবার এতো সকালে- এইসব ভাবতে ভাবতে হোস্টেলের গেটে
এসে থমকে যায় দীপা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। কিছুক্ষণ কথা সরে
না মুখ দিয়ে। ধাতস্থ হয়ে বলে...
-“তুমি ?!! তুমি কীভাবে এলে?! প্লেনে করে ?!!”
-“শুভ জন্মদিন, সোনামণি।” হাসতে হাসতে দীপাকে বলে ইফতি।
খুশিতে ওকে নিয়ে কী করবে ভেবে পায় না দীপা। হাত ধরে টেনে গেস্ট-রুমে
বসায়। দীপার জন্য আনা টুকটাক গিফট গুলো একে একে বের করে ওর হাতে দেয়
ইফতি। দীপার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। একছুটে গিয়ে ক্যান্টিন থেকে নাস্তা
এনে খাওয়ায় ইফতিকে।
-তুমি আমাকে এতোটুকুও বুঝতে দাও নি! বিস্ময় কাটতেই চায় না দীপার।
-বুঝে ফেললে তো সারপ্রাইজ দিতে পারতাম না! হাসতে হাসতে দীপার বিস্ময় উপভোগ করছে ইফতি।
একথা ওকথার পর দীপা ইফতিকে বসিয়ে রেখে চট করে তৈরি হয়ে আসে। ততোক্ষণে
বৃষ্টিটাও ধরে এসেছে। টিপ টিপ বৃষ্টিতে রিকশায় দীপার হাত ধরে বসে থাকতে
ইফতির মনে হয়- “এই তো স্বর্গ !”
- - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - - -
প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে সম্বিত ফিরে পায় ইফতি। বৃষ্টি নেমেছে আবারও। সেই
রাতেও এমনই বৃষ্টি ছিল। দীপা সুজয়ের কাছে চলে গেছে আজ কত্তদিন হয়ে গেছে,
অথচ এখনও সেই দিনটার এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না ইফতি। কে যেন একবার
বলেছিল, বছরের একটা বিশেষ দিন বার বার ফিরে আসে, কিন্তু সেই দিনের ঘটনা
গুলো আর কোনও দিন ফেরে না।
আজ দীপার জন্মদিন। দেখতে দেখতে একটা
বছর পার হয়ে গেছে, টেরই পাওয়া যায় না। ইফতির হঠাৎ করে মনে হয়, আচ্ছা,
আজকে কি সুজয়ের সাথে সারারাত কথা বলবে দীপা? সুজয়ও কি ওকে চমকে দিতে
রাজশাহী গেছে? রিকশায় বসে আজ সারাদিন হাজারও কথা বলতে বলতে রাজশাহীর এ গলি
ও গলি ঘুরে বেড়াবে ওরা? দীপার কি আজ একটা বারের জন্যও মনে পড়বে ইফতির
কথা? সুজয় ওকে ফুল দেয় তো? ইশ, মেয়েটা খুব চকলেট খেতে ভালবাসে! মনে করে
সুজয় ওর জন্য চকলেট নিয়ে গেলে হয়!
অর্থহীন স্মৃতিচারন করতে করতে বারান্দায় এসে দাড়ায় ইফতি। আকাশের দিকে মুখ তুলে মনের অজান্তেই বুকটা চীরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
-“শুভ জন্মদিন, সোনামণি !” অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে সে।
বৃষ্টির জলে ধুয়ে নিয়ে যায় ইফতির অশ্রু।